প্রশ্ন : একটি আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে নাগরিক কমিটি কাজ শুরু করলেও আপনারা বলেছেন তৃণমূল পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটানো হবে। রাষ্ট্রের জরুরি সংস্কার ও পুনর্গঠনে নাগরিক কমিটির কার্যপদ্ধতি কেমন হবে?
উত্তর : আমরা দেখেছি ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সংবিধান থেকে শুরু করে আমাদের আইনি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর মধ্যে ফ্যাসিজমের অনেক উপাদান রয়ে গেছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার যে অবশেষ রয়েছে সেগুলো বিলোপ করব।
বাংলাদেশের মানুষ সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চেয়েছে। সে ক্ষেত্রে এখনও বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি। জায়গাটা অধরাই থেকে গেছে। একজন রিকশা শ্রমিক, চা শ্রমিক, একজন মজুর, তাদেরও তো চাওয়ার জায়গা রয়েছে। আমার মনে হয় এর জন্য একটা ‘প্রো-পিপল’ বা জনবান্ধব নীতি দরকার। একই সঙ্গে এই জায়গাটা তৈরিতে সময় দরকার। সেই সময়টা পর্যন্ত অর্থাৎ সেগুলো অর্জন করা পর্যন্ত নাগরিক কমিটির মাধ্যমে আমাদের লড়াইটা জারি রাখতে চাই। এটি যেমন আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম, একই সঙ্গে আমাদের সামাজিক সংগ্রামেরও অংশ। পাশাপাশি যারা এই গণহত্যায় অংশ নিয়েছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা, বিচারিক প্রক্রিয়ায় যেন তাদের নিয়ে আসা যায়, সে জন্য আমাদের একটা লড়াই থাকবে। আমরা নাগরিক কমিটিতে বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, পাহাড়-সমতলের সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণ চাই। সবার কথা শুনতে চাই এবং নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণে যেন সবার মতের প্রতিফলন থাকে, তা নিশ্চিত করতে চাই। ঢাকা থেকে শুরু করে রংপুর, খাগড়াছড়ির মতো জেলা থেকে থানা, গ্রাম পর্যায়েও আমাদের কমিটির বিস্তৃতি ঘটাতে চাই, যেন তৃণমূলের মানুষের কথাও শুনতে পারি।
প্রশ্ন : একটা গুঞ্জন আছে জাতীয় নাগরিক কমিটি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হতে পারে…
উত্তর : নাগরিক কমিটি কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তবে এটি একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ। এই মুহূর্তে নাগরিক কমিটি মনে করে তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের জায়গা হচ্ছে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করা। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের সব তরুণ-যুবকদের সংহতির মধ্য দিয়ে সংঘবদ্ধ করা এবং দেশি-বিদেশি যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আমাদের গণঅভ্যুত্থানের যে আকাংখা, যে চাওয়া সেটিকে রক্ষার জন্যই জাতীয় নাগরিক কমিটি সবসময় কাজ করে যাবে।
রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গ যদি বলি, আমাদের এখানে যারা আছেন তারা যদি ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল করতে চান, তারা যদি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন পান বা আরও কোনো তরুণ গ্রুপ তারা যদি রাজনীতি করতে চান, সেটি ভবিষ্যতের বিষয়। কিন্তু তা কোনোভাবেই নাগরিক কমিটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। আমরা মনে করি, নাগরিক কমিটির কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ করে যাওয়া।
প্রশ্ন : দেশে একের পর এক মব জাস্টিস এবং মব ট্রায়ালের ঘটনা ঘটছে। কেউ কেউ বলছেন, জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাবে এমন মনোভাব থেকে প্রশাসন কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইনের শাসন নিশ্চিতে নাগরিক কমিটির বিশেষ কোনো কর্মতৎপরতা কিংবা চিন্তা আছে কি?
উত্তর : এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। বাংলাদেশে ‘রুল অব ল’ বা আইনের শাসনের পক্ষে আমরা সবসময় কথা বলে এসেছি। বিভিন্ন জায়গায় মন্দির-মাজারে হামলার মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে। অনেক জায়গায় সরকার ত্বরিত পদক্ষেপ নিলেও কয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। দেশের অনেক থানাতে পুলিশ প্রশাসন এখনও ফাংশনেবল হয়ে উঠতে পারেনি। গত আন্দোলনে নৃশংস ভূমিকার কারণে পুলিশ প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থার জায়গাটা একেবারে নড়বড়ে হয়ে গেছে। তারা নৈতিকভাবে এখনও নিজেদের মনোবল ফিরে পায়নি। সামগ্রিকভাবে এখানে একটা ব্যর্থতার জায়গা তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করি, পুলিশে দ্রুত সংস্কার দরকার। একই সঙ্গে মব জাস্টিসের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
দেশে পুলিশ প্রশাসনকে সুসংহত করার বদলে সরকার সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিল।
প্রশ্ন : অনেকে মনে করেন সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতা দেশের প্রশাসনিক দুর্বলতাকে আরও দীর্ঘায়িত করবে। নাগরিক কমিটি বিষয়টি কীভাবে দেখছে।
উত্তর : হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই দেশে যখন ডাকাতের প্রকোপ বেড়ে গেল তখন মানুষ সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একই সঙ্গে চাঁদাবাজির মতো ঘটনা বাড়তে লাগল। কিছু কিছু জায়গায় সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে এখন ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণে সেনাবাহিনীকে কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে মানুষের মনে আশঙ্কার জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশে আবার সেনাশাসন ফিরে আসে কি না। সে জায়গায়ও আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখার পক্ষপাতী। তবে ল অ্যান্ড অর্ডারও ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন পুলিশ বাহিনী একেবারে মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় রয়েছে। সে জন্য বাহিনীটিকে একটা সময় বেঁধে দিয়ে তার মধ্যে সংস্কার করতে হবে। এরপর অতিরিক্ত দায়িত্ব থেকে সেনাবাহিনীকে অব্যাহতি দিতে হবে।
প্রশ্ন : আপনারা নতুন সংবিধানের কথা বলেছেন। এ বিষয়ে নাগরিক কমিটির সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা আছে?
উত্তর : পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদকে সংশোধনের অযোগ্য করে রাখা হয়েছে। এই সংবিধানে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো বিষয়ই অবশিষ্ট রাখা হয়নি। সংবিধানে এমন অনেক বিষয় আছে যা বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অবশ্য ভালো কিছু জিনিসও রয়েছে। কিন্তু আমরা সামগ্রিকভাবে এই সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকার কথা তার কিছুই দেখি না। এখানে সব ক্ষমতা এক প্রধানমন্ত্রীর কাছে রাখা হয়েছে, যা ফ্যাসিবাদী এবং একক কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বারবার সহযোগিতা করেছে। সেই জায়গা থেকে আমরা নতুন সংবিধানের কথা বলেছি।
প্রশ্ন : সংবিধান পুনঃলিখনের প্রশ্নে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির প্রশ্নে নগরিক কমিটির অবস্থান কী?
উত্তর : এখানে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব পক্ষ মতামতের ভিত্তিতে ঠিক হবে নতুন সংবিধান কোন কোন মূলনীতির ভিত্তিতে প্রণয়ন হবে; কোন কোন বিষয় এখানে প্রাধান্য পাবে, আওতাভুক্ত থাকবে এবং একই সঙ্গে আগের সংবিধানের কোন কোন বিষয়কে এই সংবিধান গ্রহণ করবে না।
প্রশ্ন : নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যুক্ত করার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ না করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে কি না?
উত্তর : আমরা নাগরিক কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারকে যেমন সহযোগিতা করতে চাই, তেমনি পর্যালোচনার ভিত্তিতে রাখতে চাই, সমালোচনাও করতে চাই। হাজার হাজার শহিদের জীবন ও আহত ভাইদের রক্তের বিনিময়ে অন্তর্বর্তী সরকার এই দায়িত্ব পেয়েছে। তাদের দায়িত্ব রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা। সে দায়িত্বের কতটুকু তারা বাস্তবায়ন করছেন, কোন সময়ের মধ্যে কতটুকু তারা করছেন, নাগরিক কমিটি তার জায়গা থেকে পর্যালোচনাগুলো জারি রাখবে। গণঅভ্যুত্থানকে রক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশের মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করবে। কিন্তু একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ যদি কোনো অনিয়ম দেখে, জনস্বার্থের পরিপন্থি কিছু দেখে, তা হলে তাদের সমালোচনা করা এবং পর্যালোচনা করার বিষয়টি যেন অক্ষুণ্ন থাকে, সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তুলছেন অনেকে। আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
উত্তর : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশেই জুলাই-আগস্টের গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া বিগত সময়ে ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকাণ্ড, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজত হত্যাকাণ্ডসহ গত ১৫ বছরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আমরা দেখেছি শত শত মানুষকে গুম করা হয়েছে, খুন করা হয়েছে। এই অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে যথাযথভাবে বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। যারা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন, বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছেন, তাদেরও শাস্তির মুখোমুখি করা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের যে দলীয় কাঠামো, এর বাইরে এমন কোনো ব্যক্তিই থাকে না যারা কি না এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হননি। এর বাইরে যারা অপরাধের সঙ্গে একদমই জড়াননি, তাদের বিষয়টি ভিন্ন। কিন্তু যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছেন তাদের প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। বিচারের আগে তাদের আওয়ামী লীগের নামে রাজনীতি করার কোনো বৈধ অধিকার নেই। নৈতিকভাবেও কোনো অধিকার নেই এবং বাংলাদেশের মানুষ তা বরদাশতও করবে না।
প্রশ্ন : আপনি ডাকসুর সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির আহ্বায়কের দায়িত্বও পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নে আপনার অবস্থান কী?
উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে বিগত সময়ে আমরা ছাত্ররাজনীতির যে ভয়াল রূপ দেখেছি, তার বড় কারিগর ছাত্রলীগ। তারা ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব করেছে। চাঁদাবাজি করেছে। হলে গেস্টরুম সংস্কৃতি চালু করেছে। জোর করে শিক্ষার্থীদের দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে গেছে। আমাদের ওপর অসংখ্যবার হামলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসব নিয়ে যারপরনাই হতাশ হয়ে পড়েছিল এবং তারা তাদের অধিকার থেকে একের পর এক বঞ্চিত হচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা আগের ছাত্রলীগের প্যাটার্নের রাজনীতি, সন্ত্রাসের যে রাজনীতি তাকে আর প্রশ্রয় দিতে চায় না। সেই জায়গায় অপারপর যে ছাত্র সংগঠনগুলো আছে, তারা যখন ক্ষমতায় আসবে তখন তারা কেমন আচরণ করবে, তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে একটা ভয় আছে। এ ভয়টা অমূলক নয়। যে কারণে শিক্ষার্থীদের সামনে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রস্তাবনা হাজির করা প্রয়োজন। সেই প্রস্তাবনাগুলো যদি শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করে তা হলে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়টির সমাধান হতে পারে এবং এটি দরকারও। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক তৎপরতার অর্থ হলো শিক্ষার্থীরা নিজের জায়গা থেকে রাজনৈতিক বোঝাপড়া থাকবে, দেশের বিভিন্ন সংকটে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে ছাত্ররাজনীতির কারণে কোনো শিক্ষার্থীর পড়াশোনা যেন বিনষ্ট না হয়। তাকে যেন মারধরের শিকার না হতে হয়। সে যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য না হয়। এ জন্য প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রতি সৎ থাকতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেন কোনোভাবেই লঙ্ঘিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা মনে করি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হলে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে বর্তমানে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা কেটে যাবে এবং একটি ইতিবাচক ধারার পরিবেশ তৈরি হবে।