ঢাকাবার্তা ডেস্ক।।
নাম কারিনা ঘোষ (২১)। এইচএসসি পাস করে সেবিকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দেড় বছর আগে কুষ্টিয়া থেকে রাজধানী ঢাকায় এসেছিলেন নার্সিং নিয়ে পড়াশোনা করতে। ভর্তি হয়েছিলেন আনোয়ার খান মর্ডান মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে। নার্সিংয়ের বিএসসি কোর্সে। কোর্সের দ্বিতীয় বর্ষ চলছিল। এবার পুজোর অনুষ্ঠান পরিবারের সঙ্গে উদযাপনের কথা বলেছিলেন কারিনা। এজন্য বাবা কিরণ ঘোষকে আগেই বলে রেখেছিল পুজোর আগে যেন তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পূজার সময় বাবা-মা, ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হলো না তার।
মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) রাতে পূজার অনুষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরে, সব স্বপ্নকে পেছনে ফেলে হঠাৎ নিভে গেলো সেই কারিনা। এদিন সন্ধ্যায় রাজধানীর কলাবাগান থানাধীন ক্রিসেন্ট রোডের পাশে একটি নারী হোস্টেলের পঞ্চম তলার ৫০২ নম্বর কক্ষ থেকে কারিনার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মৃত্যুর আগে ওই দিনই ছোট ভাই চিত্র ঘোষকে ফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কারিনা যে কথাগুলো বলেছিলেন সেই ভয়েস রেকর্ডটি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। সেটি হুবহু তুলা ধরা হলো– ‘আমি তোকে অনেকবার ফোন দিয়েছি চিত্র। বাবাকেও অনেকবার ফোন দিয়েছি। বাবা ঘুমাচ্ছে। এ টাকাটা বাবাকে দিস। এমনি বাবার অনেক কষ্ট। হয়তো দেখা হলো না আমার সাথে। কথা হয়তো হলো না বাবার সাথে। বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমার ভাগ্যের সঙ্গে এমন খারাপ কিছু হবে আমি কখনও কল্পনা করিনি। আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারিনি মেয়ে হয়ে। আমাকে মাফ করে দিও বাবা। আমি জানি তুমি ভাবো আমি অনেক খারাপ। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না বাবা। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা। বিজয় দশমীর প্রণাম নিও বাবা। আমি তোমাকে অনেকবার ফোন করেছিলাম, কিন্তু তুমি ফোন ধরোনি। তুমি ঘুমাচ্ছিলা। পিসিদেরকে বলিস পিসিদেরকেও আমি অনেক ভালোবাসি। আমাদের পরিস্থিতি খারাপ ছিল। আমাদের সবকিছু খারাপ ছিল। আমাকে তোরা ক্ষমা করে দিস। চিত্র, দিদির একটাই কথা, তুই খারাপ পথে যাস না।’
মেয়েকে নিয়ে বাবা কিরণ ঘোষ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল পূজা শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে। তখন মেয়ে আমাকে বলেছিল এবার পূজার অনুষ্ঠান একসঙ্গে উদযাপন করতে। এজন্য আমরা যেন তার কাছে ঢাকায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে একসঙ্গে পুজো উদযাপন করি। এরপর আমার সঙ্গে আর কথা হয়নি। ওই দিন মারা যাওয়ার আগে সে আমাকে ফোন করেছিল, আমি ধরতে পারিনি, তখন ঘুমে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে আমার মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আট মাস ধরে স্ত্রী লক্ষ্মী ঘোষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। কোর্টে মামলা চলছে। আমার স্ত্রী বর্তমানে আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও বসবাস করে। অন্য আরেকজনের সঙ্গে তার (স্ত্রীর) সম্পর্কও রয়েছে। এসব নিয়ে হয়তো মেয়ের মনের মধ্যে কিছু চলছিল, কিছু ভাবছিল বা অন্য কোনও কারণও হতে পারে। মৃত্যুর পেছনে যদি কোনও ক্লু পাই তাহলে আমি মামলা করবো।’
এ বিষয়ে কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক এস আই লিজা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৯৯৯-এর মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় কারিনা ঘোষের মরদেহ উদ্ধার করি। এ সময় তার দেহ ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। আমাদের ধারণা, সে পূজার অনুষ্ঠান শেষে বিকালে ফিরে সন্ধ্যার মধ্যে যেকোনও সময় এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পরে আশপাশের কেউ দেখতে পেয়ে ৯৯৯ নম্বরে পুলিশকে সংবাদ দেয়।’
তিনি বলেন, ‘স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, কারিনা ঘোষ ওপরে ওপরে সবার সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল থাকলেও ভেতরে অভিমান চেপে রাখছিল।’
তবে কী কারণে, কেন, এমনটি হলো, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এছাড়া ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে বলেও জানিয়েছে কলাবাগান থানা পুলিশ।
কারিনার মামা স্বপন মজুমদার বাবু বলেন, ‘আমি সংবাদ শুনে এসেছি। কারিনা নার্সিংয়ের ওপর আনোয়ার খান মর্ডান মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে বিএসসি কোর্সে পড়াশোনা করছিল। বর্তমানে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। থাকতো ক্রিসেন্ট রোডে, একটি নারী হোস্টেলে। সে মঙ্গলবার পূজার অনুষ্ঠানেও গিয়েছিল। পরে রাতে শুনি তার ঘটনার কথা। কী কারণে এ ঘটনা, তা জানতে পারিনি।’
ঘটনার পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে বুধবার (২৫ অক্টোবর) কারিনা ঘোষের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মফিজ উদ্দিন বিশ্বাস সড়ক এলাকার মজুমপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে। সেখানেই তার শেষ শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারিনা ঘোষের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনার পর তার বাবা-মা দুই জনই থানায় এসেছিলেন। কারিনার রুমমেটদের সঙ্গে কথা বলে আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, গত মাসের ২৩ তারিখ তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়। এরপর থেকে তার আচরণ পরিবর্তন হয়। বেশিরভাগ সময় তার মন খারাপ থাকতো। এছাড়া মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে কিনা এখনও আমরা জানতে পারিনি।’
আরও পড়ুনঃ মহাখালীর খাজা টাওয়ারে আগুন লাগায় ইন্টারনেট–সেবায় বিঘ্ন