আলতাফ পারভেজ ।।
হেনরি কিসিঞ্জারের যখন ১০০ বছর পূর্তি হচ্ছিল, তখন সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের একালের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনে। সেখানে কিসিঞ্জারকে নিয়ে অনেক প্রশংসামূলক লেখা বের হয়। ২৭ মে রাষ্ট্রীয় মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে কিসিঞ্জারকে নিয়ে যে সম্পাদকীয় লেখা হয়, সেখানে ছত্রে ছত্রে ছিল তাঁর প্রশংসা।
দেখা গেল, কিসিঞ্জার প্রশ্নে চীন ও আমেরিকার কুলীন সমাজ একই রকম ভাবছে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রাষ্ট্রদূত শিই ফেইং এ উপলক্ষে কিসিঞ্জারের সঙ্গে উপহারসহ দেখা করেছেন।
কিসিঞ্জারের কূটনীতিক জীবনের এক বড় দাবি, তিনিই যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের নির্মাতা। নিক্সনের আমলে এই সম্পর্কের সূচনা ঘটিয়েছিলেন তিনি। চীনও এই অবদানের কথা স্বীকার করে। এমনকি এখনো, যখন তাদের কোনো না কোনো নেতা প্রতিদিন ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে নানা বিষয়ে ক্রুদ্ধ বিবৃতি দিচ্ছে। বাংলাদেশ যুদ্ধের ফাঁকেই পাকিস্তানের সহায়তায় কিসিঞ্জার চীন অধ্যায়ের সূচনা করেন ১৯৭১ সালে গোপনে চীন সফরে যেয়ে।
কিসিঞ্জারের চীননীতির ফল হিসেবে চীন ও আমেরিকা উভয়ই দুটো বিশাল বাজার পেয়েছে। উপরন্তু চীন-রাশিয়া সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত করা গিয়েছিল তাতে, যা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য ধ্বংসাত্মক কোন্দলের কারণ হয়। অথচ এখন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবিলার আওয়াজ তুলছে।

চীনে কিসিঞ্জার, ২০১৯ সালের ২২ নভেম্বর । ফাইল ফটো
যুক্তরাষ্ট্রের কুলীন সমাজ গত দুই-তিন মাস যখন কিসিঞ্জারের জন্মদিন উদযাপন করে চলেছে, তখন এটা তারা বেশ এড়িয়ে যাচ্ছেন, পুঁজিতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী বর্তমান চীন তাদের বাজার দ্বারাই পাঁচ দশকে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে এ জায়গায় এল।
বোঝা যাচ্ছে, আপাতত কিসিঞ্জারের কোনো সমালোচনা তারা আমলে নিতে রাজি নেই। সবকিছুর বাইরে তাদের অস্বস্তি এই শতবর্ষীর মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে। কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের কেউ হলে আমেরিকার মূল ধারার সংবাদমাধ্যম হয়তো বহুকাল আগে থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে তাঁর বিচার চাইত। যদিও এটা এককভাবে কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং বিশ্বসমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতা যে এ রকম কথিত ‘সফল’ কূটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের আজও তাঁদের কাজের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনা যাচ্ছে না। চলতি বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যেই সেই দুর্বলতা রয়ে গেছে।
তবে বিশ্ব নেতৃত্বের এ রকম গাফিলতির পরও কূটনীতির অঙ্গনকে মূল্যবোধের বধ্যভূমিতে পরিণত করার জন্য ড. কের কথা মনে রাখবে চিলি, আর্জেন্টিনা, কম্বোডিয়া, লাওস, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও বহু দেশের মানুষ। তাঁরা হয়তো এ রকম মেনে নিতে চাইবেন না যে গত ১০০ বছরকে ‘কিসিঞ্জার সেঞ্চুরি’ বলা যায়, যেমনটা বলতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রচারমাধ্যম এবং আশ্চর্যজনকভাবে চীনও।