সোমবার, জানুয়ারি ২০, ২০২৫

ক্রেতা কমছে রেস্তরাঁ জোনে

সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় লেখক আরিফ আর হোসেন তার একটি স্ট্যাটাসে লেখেন, প্রিয় ফুড ব্লগাররা, আপনাদের উচিত এখন থেকে ফুডের পাশাপাশি; রেস্টুরেন্টের পরিবেশ, অগ্নিনির্বাপণী ব্যবস্থা, ফায়ার এক্সিট ইত্যাদি নিয়েও রিভিউ দেয়া।

by ঢাকাবার্তা ডেস্ক
ক্রেতা কমছে রেস্তরাঁ জোনে

স্টাফ রিপোর্টার।।

রাজধানীবাসীর জন্য চিত্ত বিনোদনের জায়গার খুবই অভাব। পর্যাপ্ত পার্ক, খেলার মাঠের অভাবে অনেকে অবসর সময় কাটাতে রেস্তরাঁ, ক্যাফেতে যান। আর এই সুযোগে সড়কে সড়কে গড়ে উঠেছে শত শত হোটেল রেস্তরাঁ। গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর এখন আলোচনার কেন্দ্রে এসব হোটেল রেস্তরাঁ। পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া গড়ে উঠা এসব হোটেল রেস্তরাঁয় যেতেও এখন মানুষ ভয় পাচ্ছেন। বেইলি রোডের ঘটনার পর রেস্তরাঁ জোন হিসেবে পরিচিত স্থানগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন ভয় থেকেই অনেকে রেস্তরাঁয় বসা এড়িয়ে চলছেন।

ভোজন রসিকদের পছন্দের জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম বেইলি রোড, ধানমণ্ডি, ঝিগাতলা, মিরপুর ১,২, ১২। এসব স্থানগুলোর রেস্তরাঁগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা যায় কমছে গ্রাহকদের আনাগোনা। গতকাল দুপুরে মিরপুর-২ নম্বরে জনপ্রিয় একটি কাচ্চির দোকানে যাওয়া ক্রেতা আকাশ রায়হান বলেন, ভয় তো একটা কাজ করছেই। কিন্তু পূর্বপরিকল্পিত হওয়ায় আসতেই হলো। রেস্তরাঁটিতে দুপুরে দোতলায় খাচ্ছিলেন অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জন মানুষ। এরপরও ফাঁকা পড়ে ছিল বেশ কয়েকটি সিট। কিন্তু এই রেস্তরাঁতেই অন্যদিন দুপুরে টোকেন নিয়ে করতে হতো অপেক্ষা।

 

সনি স্কয়ারের ভেতরে অন্তত ২৫টি রেস্তরাঁ। যার প্রতিটি কোণায় কোণায় ভিন্নতা। বৈচিত্র্যময় পরিবেশে ছবি তোলেন খাদ্য রসিকরা। ভিড় লেগেই থাকে জায়গাটিতে। কিন্তু গতকাল দেখা মেলে ভিন্ন চিত্র। গ্রামীণ আবহে তৈরি এক রেস্তরাঁর ম্যানেজার বুধ-বৃহস্পতিবার ও শুক্র-শনিবারের ‘গেস্ট অর্ডার লিস্ট’র তালিকা দেখে বলেন, বুধবার রেস্তরাঁটিতে অর্ডার নেয়া হয়েছিল ২১৮টি। পরদিন তা বেড়ে হয় ২৭৭টি। বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর শুক্রবার অর্ডার আসে ১২২টি ও শনিবার তা বেড়ে হয় ১৬৪টি। এই হিসেবে তাদের রেস্তরাঁর অর্ডার কমেছে ৪২ শতাংশ। আরেকটি রেস্তরাঁর হিসেবে দেখা যায় অর্ডার কমেছে ৩৪ শতাংশ। সনি স্কয়ারে খেতে আসা আশরিফা পিয়া বলেন, ঢাকায় আমাদের বিনোদনের বড্ড সংকট। আমরা বসে একটু যে আড্ডা দেবো তার জায়গা কই? নিরাপত্তা কই? তাই এসব রেস্তরাঁয় সময় কাটাই, খাবার খাই। কিন্তু এখন একটা ভীতি কাজ করছে।

ভবনটির একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, প্রতিটি রেস্তরাঁয় কিচেনেই রয়েছে গ্যাসের সিলিন্ডার। ওঠানো-নামানো ঝামেলা ও খরচ বেশি হওয়ায় একবারে ওঠানো-নামানো করেন। অনেকে সপ্তাহে একবার আবার অবস্থা বুঝে এক মাসেও একবার ওঠানো-নামানো করেন। প্রতিটি রেস্তরাঁতেই থরে থরে সাজানো আছে সিলিন্ডার।

বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী আদনান মো. সাদ। অনার্স চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থী ক্যাফে গার্ডেনে খাদ্য সরবরাহের কাজ করেন। তিনি বলেন, আমাদের কিচেনে সবসময় দুটা সিলিন্ডার থেকে চুলা জ্বলে। কাস্টমার বেশি হলে চারটি পর্যন্ত চুলা জ্বালানোর ব্যবস্থা আছে। আগে কখনো নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করিনি। কিন্তু বেইলি রোডের ঘটনার পর একটা ভয় কাজ করছে। এখন আমারা জীবন হাতে নিয়ে কাজ করছি।

বেইলি রোডের পুরো এলাকা জুড়েই রেস্তরাঁ জোন। এখনো আতঙ্ক কাটেনি এলাকাটিতে। একটি রেস্তরাঁ গরু-খাসির পায়া, নল্লি ও চুই ঝালের জন্য নাম কুঁড়িয়েছে। এই দোকানের ফুড টেস্টার ও সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার জীবন চৌধুরী বলেন, আমাদের অর্ডার ও অকেশন ছাড়া প্রতিদিন ৩০ কেজি মাংস রান্না করা হয়। শুক্রবার রান্না করা হয় ৪০ কেজি। আর অকেশন বুঝে এটি আরও ২০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত বেড়ে যায়। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের পরদিন আধা বেলা খোলা ছিল দোকান। সেদিন বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬/৭ কেজি মাংস। শনিবার বিক্রি হয় ১৩/১৪ কেজি মাংস। তিনি বলেন, রোববার সকাল থেকেই রেস্তরাঁ খোলা। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ৯/১০ কেজির বেশি মাংস বিক্রি হয়নি। ক্রেতারা আসছেন কম। আবার যারা আসছেন অনেকেই প্রশ্ন করছেন গ্যাস সিলিন্ডার, নির্গমন পথ, নির্বাপণ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। শুধু তারা নয় আমরাও ভয়ে আছি। আমাদের তিন জন ওয়েটার দু’দিন ধরে আসছেন না। ম্যানেজার কিছু বলতেও পারছেন না। আমরা যে সবাই ভয়েই আছি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যুরিজম ও হোটেল ম্যানেজমেন্টে অনার্স ও হোটেল ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স সম্পন্ন করা জীবন বলেন, এতগুলো মানুষ মারা গেল আমরা মর্মাহত। বাংলাদেশের রেস্তরাঁগুলোয় কোনো নিরাপত্তা টুলসই নাই। আমাদের সেই সংস্কৃতিটাই গড়ে ওঠে নাই। আমরা বইয়ের পাতায় যেসব সেফটি টুলস নিয়ে পড়েছি এগুলো শুধু পড়াতেই সীমাবদ্ধ। আমাদের নিরাপত্তার সংস্কৃতিটা গড়ে ওঠা খুব জরুরি।

ঢাকায় অনার্স থেকে তুরস্কের বিশেষায়িত একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রন্ধনের ওপর ডিগ্রি নিয়েছেন আশিক আহনাফ সৌমিক। তিনি বর্তমানে ধানমণ্ডির জনপ্রিয় একটি রেস্তরাঁয় চাকরির করছেন। তিনি বলেন, আমাদের কাজটাই চুলার পাশে। বেইলি রোডের ঘটনার পর থেকে ভয় লাগা শুরু করেছে। আগে নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা কনসার্ন ছিলাম না। শেষ দু’দিনে আমার পরিবারের সদস্যরা ফোন দিয়ে বলছে সাবধানে থাকতে। আমার আট বছর বয়সী ছেলেটা ফোন দিয়ে বলছে, বাবা সিলিন্ডার থেকে দূরে থাকো। এখন সত্যি ভয় হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের জমে থাকা সিলিন্ডার ও অবস্থান নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো। যদি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয় তবে ভিন্ন চিন্তা করবো।

কিছু শৌখিন মানুষরা ফেসবুকে গ্রুপের মাধ্যমে একত্র হয়ে বিভিন্ন রেস্তরাঁর খাবারের স্বাদ নিয়ে থাকেন। এই গ্রুপগুলোতে বড় একটা অংশই শিক্ষার্থী। তারা একসঙ্গে ৪০ থেকে ৫০ জন একটি রেস্তরাঁয় খেতে যান। ‘উই আর ফুড লাভার’ নামে ব্যক্তিগত একটি গ্রুপে যুক্ত আছেন ১২২ জন। এই গ্রুপের একজন মডারেটর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রিয়ন্তি দেব নাথ। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন উদ্‌যাপনের দিনে মাসের শুরুর প্রথম বা দ্বিতীয় শুক্রবার একসঙ্গে খেতে যাই। আমাদের লক্ষ্য থাকে মাসে দু’বার এসঙ্গে নতুন একটি রেস্তরাঁয় খাবার খাওয়া। তিনি বলেন, কিন্তু বেইলি রোডের ঘটনার পর আমরা চলতি মাসের কোনো পরিকল্পনা নিতে পারছি না। অনেকের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। প্রাথমিক একটা আলোচনা ছিল শুক্রবার (৮ই মার্চ) খেতে যাবার। কিন্তু অনেকের মাঝে নেই আগ্রহ।

প্রিয়ন্তি বলেন, আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের এই গ্রুপ লিপ ইয়ার উদ্‌যাপনের উদ্দেশ্যে বেইলি রোডেই অন্য একটি রেস্তরাঁয় খেতে গিয়েছিলাম। আগুন লাগার আধা ঘণ্টা আগে আমরা খাওয়া শেষে বইমেলার দিকে যাই। আমরাও এই ভয়ানক ঘটনার শিকার হতে পারতাম। এখন আমরা হয়তো আর রেস্তরাঁয় খেতে যাবো না। গেলেও হিসাবনিকাশ করেই যাবো।

কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের মধ্যে বর্তমানে ‘ফুড ব্লগিং’ খুবই জনপ্রিয়। এমনি একজন আসিফ আদনান ও তার স্ত্রী ওয়াশফিয়া জয়া। এই দম্পতি বলেন, এটা ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য বড় ধাক্কা। এখন আমাদের ফুড সেফটির পাশাপাশি প্লেস সেফটির দিকেও নজর দেয়া উচিত। ফুড ব্লগাররাও এটা নিয়ে কিছু করতে পারি কিনা ভেবে দেখছি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় লেখক আরিফ আর হোসেন তার একটি স্ট্যাটাসে লেখেন, প্রিয় ফুড ব্লগাররা, আপনাদের উচিত এখন থেকে ফুডের পাশাপাশি; রেস্টুরেন্টের পরিবেশ, অগ্নিনির্বাপণী ব্যবস্থা, ফায়ার এক্সিট ইত্যাদি নিয়েও রিভিউ দেয়া।

 

আরও পড়ুন: রাজউকের চোখ এখন সাতমসজিদ রোডের সেই ভবনে

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net