রবিবার, ডিসেম্বর ৮, ২০২৪

গাজার বাসিন্দারা বড় হলোকস্টের মধ্যে আছেন

ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত। ২০১৪ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত, রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ২০১৬ সালে। ইতিপূর্বে তিনি আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া, জিম্বাবুয়ে, চীন, আবুধাবিতে ফিলিস্তিন মিশনে যুক্ত ছিলেন। ফিলিস্তিনিনের গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ, পশ্চিমা ও আরব বিশ্বের ভূমিকা, ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ সাবিহা আলম।

by ঢাকাবার্তা
ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান

প্রশ্ন: ব্যাপক সমালোচনার পরও আমরা জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে হামলা হতে দেখলাম। বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, ভবনগুলো গুঁড়িয়ে গেছে। বোমা মেরে মানুষ হত্যার ঘটনা থেকে ইসরায়েলকে বিরত রাখা যাচ্ছে না কেন?

উত্তর: এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব অন্ধের মতো ইসরায়েলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ইসরায়েল একটা পরিষ্কার বার্তা পেয়ে গেছে যে গণহত্যার জন্য তারা লাইসেন্স পেয়ে গেছে। তারা এখন যা খুশি তা-ই করতে পারে। তারা হাসপাতালে, উপাসনালয়ে, শরণার্থীশিবিরে সব জায়গায় বোমা ফেলছে। এমন জায়গাগুলো তারা নিশানা করছে, যে জায়গাগুলোয় দিশাহারা ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় নিয়েছেন। তারা খাবার, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সব বন্ধ করে দিয়েছে। এমন ঘটনা বিশ্বের কোথাও কখনো ঘটেনি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও নয়। গাজার বাসিন্দারা হলোকস্টের চেয়েও বড় হলোকস্টের মধ্যে আছেন। এই কথাটা আমাদের জোর গলায় বলতে হবে। আমরা ক্যামেরার সামনে মরছি। আমার খুব ইচ্ছা, আমি জো বাইডেনকে জিজ্ঞেস করি তাঁর কেমন লাগছে এসব দেখে। ঋষি সুনাক, মাখোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী? চার হাজারের মতো শিশু খুন হয়েছে। তারপরও তাঁরা ঘুমান কী করে? তারপরও তাঁরা তাঁদের জীবন উপভোগ করছেন কী করে? যখন তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি প্রশ্ন করে, তখন এই হত্যাকাণ্ডের পক্ষে তাঁরা কী বলে সাফাই গান? ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। যখন এই সব নেতা-নেত্রীর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি ইতিহাসে পড়বে যে তাদের পূর্বপুরুষেরা এসব করেছেন, তখন তাঁরা কী জবাব দেবেন? আমাদের কোনো জবাব দিতে হবে না। আপনারা আপনাদের পরিবারকে জবাব দিন।

প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে তারা ইসরায়েলকে বেসামরিক প্রাণহানি এড়ানোর কথা বলেছে, একই সঙ্গে বলেছে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে…

উত্তর: যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডের সহযোগী। যে বোমা গাজায় ফেলা হচ্ছে, সেই বোমা আমেরিকায় তৈরি, যে জাহাজ তারা ব্যবহার করছে, সেটাও আমেরিকার। ইসরায়েলের কাছে যত অস্ত্রশস্ত্র আছে, সবই আমেরিকা ও পশ্চিমাদের তৈরি। এই গণহত্যার জন্য তারাও দায়ী। ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে বলে তারা আসলে বিশ্বকে বোকা বানাতে চায়। কিন্তু তারা কত দিন এই চাতুরী করবে? যথেষ্ট হয়েছে। মানুষ এখন সব বোঝে।

প্রশ্ন: কিন্তু তাতে রক্তপাত তো বন্ধ হচ্ছে না।

উত্তর: এর মানে হচ্ছে পশ্চিমা সরকারগুলোকে কোনো কিছুই স্পর্শ করছে না। তারা তাদের অনুভূতিকে খুন করে ফেলেছে। তারা তাদের অনুভূতিকে ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়েছে।

প্রশ্ন: জো বাইডেন ইসরায়েল সফর করেছেন, ব্লিঙ্কেন এ নিয়ে দুই দফায় মধ্যপ্রাচ্যে এলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে-বাইরে যুদ্ধবিরতির দাবি উঠছে। আপনি কি মনে করেন এবার দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসবে?

উত্তর: আমাদের আর মরফিনের দরকার নেই। ৭৫ বছর ধরে আমরা মরফিনের ওপর বেঁচে আছি। আমরা এবার রোগ নির্মূল করতে চাই। এবারও যদি রোগ নির্মূল না হয়, তাহলে আমরা সহিংসতার বৃত্তে ফিরে যাব। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা যে কষ্ট ভোগ করছেন, পরবর্তী ৭৫ বছরেও সেই কষ্টের শেষ হবে না। ইসরায়েল যদি মনে করে তারা সব ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে পুরো দেশ নিয়ে থাকবে, তা-ও তারা শান্তিতে থাকতে পারবে না। যদি না তারা আমাদের মুক্তি দেয়, আমাদের মাটি ছেড়ে না যায় এবং মর্যাদার সঙ্গে আমাদের বাঁচতে না দেয়। আমি বলতে চাই, আমরা আমাদের ভূমিতে, আমাদের নিজস্ব পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়ে বাঁচতে চাই। আমরা আমাদের নিজেদের বিমানবন্দর চাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা আর সব দেশের ছেলেমেয়েদের মতো নিজের দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাক। কেন আমাদের এভাবে বাঁচতে হবে?

প্রশ্ন: ফিলিস্তিনকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্ব ফিলিস্তিনকে কীভাবে দেখে? সে হিসেবে গাজা, পশ্চিম তীর, জেনিন এই অঞ্চলগুলো কী?

উত্তর: ফিলিস্তিন দখলদারের খপ্পরে পড়া একটা দেশ। গাজা ফিলিস্তিনের দক্ষিণ দিককার প্রদেশ। পশ্চিম তীরের দখলদারদের কর্তৃত্বে চলে গেছে। গাজার সঙ্গে পশ্চিম তীরের কোনো সীমান্ত নেই। পশ্চিম তীরে যেতে হলে ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এটা একটা ছোট্ট এলাকা। এর আয়তন ৩৬৩ বর্গকিলোমিটার। দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৫-১৭ কিলোমিটার। মিসরের রাফার সঙ্গে একটি সীমান্ত আছে। একদিকে ভূমধ্যসাগর। পূর্ব ও উত্তর দিকে ইসরায়েল। আমাদের একরকম ঘিরেই রেখেছে ইসরায়েল। অনেকে গাজাকে উন্মুক্ত জেলখানা বলে। আমি বলি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। এটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছাড়া কিছুই নয়। নাৎসিরা যেমন করেছিল, এটাও তেমন।

প্রশ্ন: ইসরায়েলিরা বলার চেষ্টা করছে যে তারা গাজা ছেড়ে চলে গেছে, এর পুরো কর্তৃত্ব হামাসের। বিষয়টা একটু খোলাসা করবেন?

উত্তর: আচ্ছা। তারা বলতে চাইছে গাজার ভেতর থেকে তারা সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে সরে তারা কোথায় গেছে? তারা গাজার চারপাশ সৈন্য দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এভাবে গাজার দম বন্ধ করে ছাড়ছে। গাজাবাসী গাজা থেকে বের হতে পারেন না, ঢুকতেও পারেন না। যদি এক হাজার মানুষ গাজা থেকে অন্যত্র যেতে চান, ইসরায়েল চার-পাঁচজনকে অনুমতি দেয়। খাবার, ওষুধবাহী গাড়ি হলেও ইসরায়েলিদের অনুমতি নিতে হয়। এখন ইসরায়েলিরা নানা ধরনের গল্প সাজাচ্ছে। প্রয়োজনের সময় মানুষ এমন গল্প সাজায়। গাজায় ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০২১, ২০২২ সালেও হামলা হয়েছে। গাজার ৬০ ভাগ বিধ্বস্ত। তাঁদের বাড়িঘর নেই। তাঁরা পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁবুতে বাস করেন। যদি তারা সত্য বলতই, তাহলে তারা গাজা পুনর্গঠন করতে দিত, বারবার বোমা ফেলত না। এই অঞ্চলের ৭৫ ভাগ মানুষের কাজ নেই। বেকার এই মানুষগুলো বাকি ২৫ ভাগের ওপর নির্ভর করে। এই মানুষগুলো প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটির কর্মী।

প্রশ্ন: গাজার মানুষ পানি, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সেবার জন্য কোন কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভরশীল? শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসবের জন্যই বা কী ব্যবস্থা?

উত্তর: রামাল্লার ওপর নির্ভরশীল। ইসরায়েল পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, এর বিল দেয় রামাল্লা। গাজায় ৩৫টি হাসপাতাল আছে। বন্ধুরাষ্ট্রগুলো এখানকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল করে দিয়েছে। জাতিসংঘের স্কুলে বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। আমরা শিক্ষাকে সবচেয়ে মূল্যবান মনে করি। ধরুন, কারও পকেটে যদি টাকা না থাকে, কিন্তু একটি পিএইচডি থাকে, তাহলে মা–বাবা কন্যা সম্প্রদানে একটুও ইতস্তত করবেন না। তো যা বলছিলাম, গাজায় ইন্দোনেশিয়ার হাসপাতাল আছে, মালয়েশিয়ারও আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে গাজার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করেন। এই মুহূর্তে গাজার হাসপাতালগুলোয় বাংলাদেশ থেকে পাস করা ৩০ জন ডাক্তার কাজ করছেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। ইসরায়েলিরা যা করেছে তা হলো তারা হাসপাতালগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কারণ, এখানে এসে মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকগুলো হাসপাতাল জ্বালানির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকলে ইনকিউবেটরে থাকা বাচ্চারা কীভাবে বাঁচে? অস্ত্রোপচার কীভাবে চলছে, বলুন? নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র প্রায় বন্ধ। আলো ছাড়া তো অস্ত্রোপচার হয় না। হাসপাতালগুলো ধসে পড়েছে। আজকে এসে শুনতে পাচ্ছি, জো বাইডেন যুদ্ধে বিরতি চান। তাঁরা কখনো গাজায় এসে দেখেননি যে এখানে কী অবস্থা। তাঁরা এখনো ইসরায়েলের পেছনে দাঁড়াতে চান। কিন্তু তাঁদের জনগণই বিরোধিতা করছেন। তাঁরাও বলছেন, যথেষ্ট হচ্ছে। এখন তাঁদেরও মূল্য চুকাতে হবে।

প্রশ্ন: ইসরায়েলকে সমর্থনকারী দেশগুলোকে কীভাবে মূল্য চুকাতে হবে? একটু ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তর: আমরা ফিলিস্তিনিরা সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছি। মানুষের তো বিবেক-বুদ্ধি আছে। তারা জানে বর্বরতা দেখেও চুপ করে থাকার অর্থ বর্বরতাকে সমর্থন দেওয়া। মানুষ সেটা করতে পারে না। তাদের সরকারের কথা আমি বলছি না। কিন্তু এ কথা সুনিশ্চিত, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই তাদের নেতাদের জবাবদিহি করবে। কারণ, তারা মানবিক মূল্যবোধের কথা সবচেয়ে বেশি বলে। ভেবে দেখুন তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে কীভাবে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়। যখন আমরা দেখি তারা এসব মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না, তখন আমরা তাদের কীভাবে বিশ্বাস করব? তাদের কি কোনো দিন কেউ আর বিশ্বাস করবে? আমি তাদের বলতে বোঝাচ্ছি মার্কিন সরকার ও তাদের মিত্রদের। জনগণকে নয়। আমরা বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। আমরা রক্ত দিচ্ছি, আমাদের শিশুসন্তানেরা জীবন দিচ্ছে, আমাদের নারীরা মরছেন, আমাদের ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে—কিন্তু এসব কিছুর বিনিময়ে আমরা মানুষের হৃদয়টা পেয়েছি। মানুষের সমর্থনই এখন আমাদের ভরসা।

প্রশ্ন: আপনি যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের কথা বললেন। আরব বিশ্ব থেকে আপনারা কেমন সাড়া পেয়েছেন? একমাত্র জর্ডানের বাদশাহ কিং আবদুল্লাহকেই কিছু শক্ত কথা বলতে শুনেছি আমরা। তাঁদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন। বাকি দেশগুলোর কী অবস্থা?

উত্তর: আরব বিশ্ব যা করছে তা ‘ঠিকঠাক’। কিন্তু যখন মানুষ ডুবে যেতে থাকে, তখন তাকে টেনে তুলতে হয়। কেবল প্রতিশ্রুতিতে কাজ হয় না। আমরা ডুবে যাচ্ছি। সাঁতরাচ্ছি না। এখন কিছু একটা করার সময়। তারা মিষ্টি কথা বলছে। তারা আমাদের সমর্থনও দিচ্ছে। কিন্তু মুখের কথা কি আমাদের ডুবে যাওয়া রুখতে পারে? গাজার মানুষের খাবার, পানি, ওষুধ, জ্বালানি দরকার। আমাদের কাগজে কী লেখা আছে, তা এখন জানার দরকার নেই। ২২টি আরব দেশ ট্রাকে পতাকা তুলে গাজা সীমান্তে গিয়ে দাঁড়াক। জোর করে ঢুকে পড়ুক। ইসরায়েল কী করবে? তারা সেটা কেন করছে না? জর্ডান ইসরায়েলি কূটনীতিবিদকে বের করে দিয়েছে। আরও চারটি দেশ আছে, যাদের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক আছে। তারাও নিজেদের কূটনীতিক প্রত্যাহার করে ইসরায়েলি কূটনীতিককে বের করে দিতে পারে। অন্তত এটা তো তারা করতে পারে। তারা জোর গলায় বলতে পারে যথেষ্ট হয়েছে। তোমাকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। ধরেন, আপনার বাচ্চা একটা অন্যায় করল। আপনি কী করবেন? তাকে শাসন করবেন। সে আর একই অন্যায় করবে না। আপনি আদুরে গলায় বলে দেখেন, আব্বু, এমন কোরো না। তাহলে সে বারবার একই অন্যায় করতে থাকবে। বিষয়টা হয়ে গেছে এমন যে ইসরায়েলকে তার মিত্ররা বলছে, খুন করতে থাক, তবে রয়েসয়ে। আমাদের চোখের সামনে না। এই পরামর্শ আইজ্যাক রবিনকেও দিয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, ‘মানুষ মারো, তবে একটু আড়াল করে।’

প্রশ্ন: ইসরায়েলিরা বলার চেষ্টা করছে হামাসের হামলার কারণেই গাজার মানুষের এই দুর্গতি, যদিও জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ৭ অক্টোবর শূন্য থেকে আসেনি। আমরা পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোয় দেখেছি ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদের বারবার একই প্রশ্ন করা হচ্ছে যে হামাসের হামলার নিন্দা করছেন কি না…

উত্তর: আন্তোনিও গুতেরেস ঠিক বলেছেন। ৭ অক্টোবর হামাসের যে হামলা, তার একটা প্রেক্ষাপট আছে, যেটির শুরু ১৯৪৮ সালে। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ইসরায়েল একের পর এক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। এই আইনগুলো কারা বানিয়েছে? আমরা? আপনারা? বানিয়েছে ইসরায়েলের মিত্ররা। আমরা শুধু স্বাক্ষর করেছি। আইন তাদের বানানো, সেই আইন লঙ্ঘন করার পরও ইসরায়েলের তোষণও তারাই করছে। ইসরায়েল জানে তারা পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে। আমি যেদিন শুনেছি হামাসের যোদ্ধারা শিশুদের হত্যা করেছে, সে রাতে ঘুমাতে পারিনি। শিশু হত্যা করে কি শহীদ হওয়া যায়? পরে আমি খোঁজখবর নিতে শুরু করি। জানতে পারি হামাস নিশানা করেছিল ওদের সামরিক স্থাপনা ও পুলিশ ফাঁড়িগুলোতে। তারা সেখানেই হামলা চালায়। যে নারীদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা সাধারণ নারী নন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে ৩০ শতাংশের ওপর নারী আছেন। ওখানে নারীদেরও সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। হামাসের পাশাপাশি আরও অনেকগুলো দল সেদিন কিবুৎজের ভেতরে ঢুকে পড়ে। তাঁরা ইসরায়েলের নাগরিকদের জিম্মি করেন। হামাস অস্ত্র হাতে ঢুকেছে। কিবুৎজে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, তা ক্রসফায়ারের ফল। মানুষ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। তারা হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে এসে পুরো গ্রাম গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

প্রশ্ন: হামাসের সঙ্গে ফাতাহর তো মতভিন্নতা আছে। হামাসের এই যুদ্ধকে আপনি সমর্থন করেন?

উত্তর: ফিলিস্তিনি বাবা-মায়ের সন্তান সে যে-ই হোক না কেন, আমার পরমাত্মীয়। হ্যাঁ, আমাদের মতাদর্শগত পার্থক্য আছে। ফাতাহ রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে। শক্তির ভারসাম্য নেই বলেই আমরা বরাবর শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা চেয়েছি। হামাস চায় যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে। ফিলিস্তিনের ৭০ ভাগ মানুষ কোনো দলকেই সে অর্থে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন না। তবে এক জায়গায় আমরা সবাই এক। আমরা সবাই স্বাধীনতা চাই। শান্তি চাই।

প্রশ্ন: আপনার নিজের কথা বলুন। আপনার পূর্বপুরুষদের বাস কোথায় ছিল? ১৯৪৮ সালে নাকবায় পারিবারিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন? ভবিষ্যৎ কী দেখেন?

উত্তর: আমার দাদা একটি শহরের মেয়র ছিলেন। শহরটির নাম আক্কা। সেই শহর ইসরায়েলে পড়েছে। ওখান থেকে আমাদের পরিবারের প্রায় সবাইকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমার বাবা কৃষি প্রকৌশলী ছিলেন। দেশের জন্য লড়াই করেছেন। কখনো নিজ বাসভূমে ফিরতে পারেননি। আমি ইসরায়েলিদের কাছ থেকে ২৪ ঘণ্টার অনুমতি নিয়ে একবার গিয়েছি। রাত ১২টায় আমার পূর্বপুরুষের ভিটায় ঢুকি, পরদিন রাত ১২টায় ফিলিস্তিনে ফিরি। আমি লেখাপড়া করেছি জাতিসংঘের স্কুলে লেবাননে। কিছুদিন সেনাবাহিনীতে কাজ করেছি। তারপর চলে যাই আফগানিস্তানের কাবুলে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক-স্নাতকোত্তর।

প্রশ্ন: ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কী দেখেন? কোনো আশা, স্বপ্ন?

উত্তর: প্রিয় বোন, আমরা ৭৫ বছর ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। আরও কত বছর লড়াই করতে হবে, জানি না। একটা কথা জেনে রাখুন, নিজ দেশে নিজ ঘরের দাওয়ায় বসে জুতা পরিষ্কার করা একটা পরাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হওয়ার চেয়ে সম্মানজনক।

প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ।

উত্তর: আপনাকেও ধন্যবাদ।

 

(প্রথম আলোর সৌজন্যে)

 

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net