সোমবার, এপ্রিল ২১, ২০২৫

চরম টাকার সংকটেও ভুগছে ব্যাংকগুলো, বাড়ছে ধার-দেনা

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নানা আর্থিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে।

by ঢাকাবার্তা ডেস্ক
চরম টাকার সংকটেও ভুগছে ব্যাংকগুলো

বাণিজ্য ডেস্ক।।

ডলার–সংকটের পাশাপাশি দেশের ব্যাংকগুলো এখন টাকার সংকটেও ভুগছে। ফলে ব্যাংকগুলো যে হারে টাকা ধার করে, সেই হার দ্রুত বাড়ছে। অনেক ব্যাংককে উচ্চ সুদে আমানতও সংগ্রহ করতে হচ্ছে। জ্যোষ্ঠ ব্যাংকার ও খাতবিশেষজ্ঞরা তারল্যের এই সংকটের জন্য তিনটি কারণকে দায়ী করছেন।

এগুলো হলো—বারবার ছাড় ও সুবিধা দেওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়া, সরকারের উচ্চ সুদে টাকা ধার নেওয়া ও বেশি দামে ডলার সংগ্রহ। তারল্যসংকট মোকাবিলায় এখন ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করতে হচ্ছে।

ব্যাংক খাত–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর শেষে ঋণ পরিশোধে আবার ছাড় মিলবে—এমন প্রত্যাশায় অনেক ব্যবসায়ী গ্রাহক ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত না দিয়ে অপেক্ষা করছেন। পাশাপাশি সরকার উচ্চ সুদে বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করায় ব্যাংকগুলো আমানত পেতে সমস্যায় পড়ছে। অন্যদিকে ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। দুই বছর আগে যে ডলার কিনতে ৮৫ টাকা খরচ হতো, তার আনুষ্ঠানিক দরই এখন ১১০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে ১২৩ টাকাও খরচ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের থেকে পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর নানা আর্থিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তারল্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে। এসব ধার ১, ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদি। ভালো হিসেবে পরিচিত অনেক ব্যাংকও এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে থাকা নগদ জমা হিসাবের (সিআরআর) ঘাটতি পূরণে টাকার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই দ্বারস্থ হচ্ছে।

পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব আদায় কম, তাই তারা ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যাচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে খরচ কমিয়ে আনতে হবে, নতুন প্রকল্প নেওয়া বন্ধ করতে হবে। সরকারি প্রকল্পগুলো যেন টাকা বানানোর যন্ত্র। আছে বিপুল অপচয়ও। এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার আমানতের সুদহারের চেয়ে কম রাখতে হবে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোটা ভুল নীতি ছিল। খেলাপিদের ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়ার মতো ভুল নীতি আর নেওয়া যাবে না। এসব করলেই তারল্য পরিস্থিতি ঠিক হয়ে আসবে।’

ঋণ ও আমানতের নিয়ন্ত্রিত সুদহারের ব্যবস্থা তুলে এ খাতে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এরপর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ে সুদহার নির্ধারণে নতুন নিয়ম চালু করে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদ ৬ শতাংশ — বহুল সমালোচিত এই ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে স্মার্ট সুদহার হিসেবে পরিচিত নতুন পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্মার্ট হলো, সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। গত জুন মাসে স্মার্ট ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, যা নভেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। স্মার্ট হারের সঙ্গে ব্যাংকগুলো ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যোগ করতে পারে। ফলে ঋণের সুদহার এখন বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

নিজস্ব তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ব্যাংকগুলোর সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা কমিটি (অ্যালকো) আমানত ও ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে থাকে। তারল্যসংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলোর একটি বড় অংশই এখন আমানতের ওপর ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। সংকটে পড়ে কোনো কোনো ব্যাংক এমনকি ১২ শতাংশ সুদেও তহবিল সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে। আমানতে ওপর সুদের হার বাড়ার কারণে ঘরে রাখা টাকা ব্যাংকে ফেরানোর প্রবণতা বেড়েছে। তবে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। ফলে ব্যাংকে টাকার সংকট চলছেই।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল জব্বার গণমাধ্যমকে বলেন, আমানতের বাজারে একটা খরা চলছে। সুদহার বেশ বেড়ে গেছে, এরপরও চাহিদামতো আমানত মিলছে না। অনেকে সরকারের বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। কারণ, তাতে ভালো সুদ পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ঋণ আদায়ও আশানুরূপ হচ্ছে না। এ কারণে তারল্য পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক ব্যাংক। তবে আরও কিছুদিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ব্যাংকের বাইরে থাকা মুদ্রার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, যা অক্টোবরে কমে হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। ব্যাংকিং–ব্যবস্থার বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমায় আমানত বেড়েছে ব্যাংকে। গত জুন মাসে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, যা অক্টোবরে বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। আর জুন মাসে ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, অক্টোবরে যা বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ১ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।

গত অক্টোবরে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ, তবে ওই মাসে ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যদিও গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে ঋণের চেয়ে আমানত বেশি বেড়েছে। এই চার মাস সময়ে আমানত বাড়লেও সম্প্রতি শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকে আবার চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। আর এই খবর আলোচনায় আসার পর এসব ব্যাংকের আমানতে ধাক্কা লেগেছে

 

আরও পড়ুন: ডলার সংকটে বিদেশে কার্ড দিয়ে ক্যাশ তোলা বন্ধ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net