স্টাফ রিপোর্টার।।
কৃষকদের ঘরে উঠেছে নতুন ধান। পিঠা-পায়েসসহ নানা আয়োজনে মেয়ের জামাই ও স্বজনদের নিয়ে জয়পুরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামঞ্চলে শুরু হয়েছে নবান্ন উৎসব। উৎসব ঘিরে কালাই পৌর শহরের পাঁচশিরা বাজারে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। এটিকে জামাই মেলা বলা হয়। শনিবার (১৮ নভেম্বর) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনব্যাপী মেলায় চলেছে মাছ কেনাবেচার উৎসব। হয়েছে কোটি টাকার মাছ বিক্রি।
ঢাকাবার্তা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছে জামাই মেলা। প্রতি বছর দিনটির অপেক্ষায় থাকেন এই এলাকার লোকজন। পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম শনিবার পাঁচশিরা বাজারে বসে এই মেলা। সারাদিন চলে জমজমাট বেচাকেনা। স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা ১৫ দিন আগে থেকে মেলার প্রস্তুতি নেন। এক সপ্তাহ আগে থেকে এলাকায় মাইকিং করা হয়। উৎসবে যোগ দেন এলাকার মেয়ের জামাই, বেয়াই-বেয়াইন ও আত্মীয়-স্বজন। প্রতিযোগিতা করে মাছ কেনেন জামাইরা।
ঢাকাবার্তার সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহ থেকে আগে থেকেই শীত পড়ছে সীমান্তঘেঁষা কালাই উপজেলায়। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে শনিবার ভোর থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে বাজারে আসেন বিক্রেতারা। সেইসঙ্গে আসতে থাকেন জামাইরা। সকাল ৮টার মধ্যে জমে উঠে বেচাকেনা। ঢল নামে কৌতূহলী মানুষের। খালবিল, নদীনালা ও পুকুরের বিভিন্ন প্রজাতির তাজা মাছে ভরপুর হয়ে ওঠে বাজার। প্রতিটি দোকানে সাজানো ছিল বোয়াল, রুই, মৃগেল, কাতল, চিতল, সিলভার কার্প, পাঙাশ, ব্রিগেড ও বাগাড়সহ বড় বড় মাছ।

জামাই মেলা।। ঢাকাবার্ত।।
পাঁচশিরা বাজারের ইজারাদার জানিয়েছেন, এবারের মেলায় সর্বোচ্চ ২৮ কেজি ওজনের কাতল মাছ উঠেছে। এটি বিক্রি হয়েছে ৩৩ হাজার ৬০০ টাকায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে।
মাছ ব্যবসায়ী ও বাজারে আসা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম শনিবার জামাই মেলা বসে। এই দিনে নবান্ন উৎসব শুরু হয়। নতুন ধানের প্রথম রান্না উপলক্ষে মেলা বসে। উৎসব ঘিরে এলাকার মেয়ের জামাই ও আত্মীয়-স্বজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। উৎসবে যোগ দেন জামাই-মেয়ে, বেয়াই-বেয়াইন ও আত্মীয়-স্বজন।। এই দিনে সবার ঘরে নতুন চালের রান্না হয়। পাশাপাশি তৈরি করা হয় পিঠাপুলি, পায়েস, ক্ষীর, খই-মুড়ি। মিলনমেলায় রূপ নেয় প্রতিটি পরিবার।
মেলায় মাছ বিক্রি করতে আসা নজরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম জানান, এবারের মেলার জন্য পুকুর, দিঘি ও নদীনালা থেকে নানা প্রজাতির বড় মাছ সংগ্রহ করেছেন তারা। এর মধ্যে রুই, কাতল ও মৃগেল ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছেন। পাশাপাশি বাগাড়, বোয়াল ও চিতলের কেজি ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। মাঝারি আকারের সিলভার কার্প, পাঙাশ ও ব্রিগেডের কেজি ৩৯০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করেছেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মেলায় ক্রেতা ছিল বেশি। মাছও বিক্রি হয়েছে বেশ। দাম ছিল স্বাভাবিক। সন্ধ্যার মধ্যে সব মাছ বিক্রি হয়ে গেছে, কমবেশি সবাই লাভবান হয়েছেন।

জামাই মেলা।। ঢাকাবার্তা।
প্রত্যেক পরিবারের সবাই দিনটির অপেক্ষা থাকে উল্লেখ করে উপজেলার পুনট পাঁচপাইকা গ্রামের রাশেদুজ্জামান মিঠু বলেন, ‘বিশেষ করে এই উৎসবের দিনে মেয়ে, মেয়ের জামাইকে দাওয়াত দিতে হয়। আবার বাড়িতে ফেরার সময় মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জন্য খাবার দিতে হয়। নবান্ন উৎসব ঘিরে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই মেলা। এবার মেলা থেকে ছোট-বড় মিলে ৫০ হাজার টাকার মাছ কিনেছি।’
কালাই পৌর শহরের পূর্বপাড়া মহল্লার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘মেয়ে, মেয়ের জামাই, নাতি-নাতনি ও আত্মীয়-স্বজন দিনটির অপেক্ষায় থাকে। এবারও সবাইকে দাওয়াত দিয়েছি। মেয়ের জামাই মেলা থেকে ৯ কেজি ওজনের একটি কাতল মাছ কিনে এনেছে। এই মাছ ও নতুন ধানের চাল দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করবো।’

জামাই মেলা।। ঢাকাবার্তা।
প্রতি বছর এই দিনে পাঁচশিরা বাজারে মেয়ের জামাইদের জন্য মাছের মেলা বসে বলে জানালেন বাজারের ইজারাদার ছানোয়ার হোসেন ছানো। তিনি বলেন, ‘মেলার এক সপ্তাহ আগে থেকে এলাকায় মাইকে প্রচার করা হয়। এই দিনে প্রচুর মাছ আমদানি যেমন হয়, তেমনি বিক্রিও হয়। এটিকে সবাই জামাই মেলা বলে।’
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বাবু মুনিশ চৌধুরী ঢাকাবার্তাকে বলেন, ‘মেলা থেকে বড় বড় মাছগুলো কিনে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যান এলাকার জামাইরা। এই দিনে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। মেয়ে, মেয়ের জামাই ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সবাই এই দিনে উৎসবে মাতেন। ঘরে ঘরে পিঠাপুলি, পায়েস, ক্ষীর, খই-মুড়ির আয়োজন করা হয়।’
মেলায় ছোট-বড় সব ধরনের মাছ বেচাকেনা হয় বলে উল্লেখ করেছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ার আলী। তিনি বলেন, ‘আজকের মেলায় কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা হয়েছে। এতে মাছ চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে।’
কালাই পৌরসভার মেয়র রাবেয়া সুলতানা বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে নবান্ন উৎসব ঘিরে এই মেলা বসে। উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। দিন দিন মেলার পরিধি বাড়ছেৎসব