মিশুক চৌধুরী ।।
জামিলুর রেজা চৌধুরীকে নিয়ে লেখা! কম পর্যবেক্ষণ নিয়ে পাবলিকলি ব্যাক্তির ক্রিটিকে আমার আগ্রহ নেই। তবুও করা। বলা যায়, অনুরোধে না করতে পেরে।
গতকাল হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন জেআরসি বলে পরিচিত এই জামিলুর রেজা চৌধুরী। তাঁর এক-দুইটি পরিচয় নয়। একগাদা পরিচয়। এসব পরিচয় মূলত এসেছে নানা ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে যুক্ত রাখায়। মূলত তিনি ছিলেন বহুবিদ। বুয়েটের সিভিলের শিক্ষকতা থেকে নিজেকে যুক্ত করেছেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, রাজনীতি, কনসাল্টেন্সিসহ নানা ক্ষেত্রে। তাঁর এসব কাজ নিয়েই তাঁকে ক্রিটিকের চেষ্টা।
শিক্ষক হিসেবে তাঁর শিক্ষার্থীরা তাঁকে অনুপ্রেরণা হিসেবে অভিহিত করেন। বিশেষ করে গাইডলাইনে। এ ব্যাপারে প্রথম আলোর ফেসবুক লাইভে বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদি হাসান আনসারির আলাপ শুনছিলাম, তিনি বলছিলেন তাঁর ক্যারিয়ারের গাইডলাইনে জেআরসির ভূমিকা রয়েছে পুরোপুরি। মেহেদী হাসান আনসারি দেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন।
শুধু মেহেদী হাসান আনসারী নয়, তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল রাজধানীর এশিয়া-প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির (ইউএপি) শিক্ষার্থীদের সাথেও তিনি আলাপ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা-সমস্যা নিয়ে। নিঃসন্দেহে ভালো দিক। এছাড়া খেয়াল করলে দেখবেন, ইউএপিতে তিনি উপাচার্য থাকাকালীন প্রতিটি বিভাগে এমন শিক্ষক দ্বারা ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, দেশে ওই সেক্টরে এক্সপার্ট বা কাজের জন্য যাদের সুনাম রয়েছে। দেশের আরেক শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাকেরও উপাচার্য ছিলেন তিনি। তাঁর দায়িত্বের সময় এবং পরবর্তীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
এই পুরকৌশলবিদ দেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যমুনা সেতু ও পদ্মা সেতু―দুইটিতে জড়িত ছিলেন। এছাড়া ঢাকার নগরায়নসহ এই সেক্টেরের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রকল্পে তাঁর উপস্থিতি ছিল। পেয়েছেন একুশে পদক। জাতীয় অধ্যাপকের স্বীকৃতিও মিলেছে। আমার কাছে এগুলোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, গণিত অলিম্পিয়াড ও এসিএম-আইসিপিসিতে বাংলাদেশী তরুণদের নিয়ে জামিলুর রেজা চৌধুরীর কাজ।
গণিত অলিম্পিয়াড প্রথম আলোর উদ্যোগ হলেও এর মূল কাজটা সারেন স্বেচ্ছাসেবীরা। আর দীর্ঘদিন তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন জেআরসি। এখন প্রতি বছরই বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বৃত্তি নিয়ে এই দেশের তরুণ-তরুণীরা পড়তে যায়। সংখ্যায় সেটা হয়তো এখনও কম। তবে এটার পেছনে পুরো ভূমিকা গণিত অলিম্পিয়াড, এসিএম-আইসিপিসির। এসব প্রতিযোগিতায় ভালো করা শিক্ষার্থীদের স্থান হচ্ছে হার্ডাড, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ডসহ উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। শুধু কী ভর্তি? গণিত অলিম্পিয়াড সারা দেশের স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করছে গণিতে। মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে প্রবলেম সলভ করার বিষয়টি। একইভাবে এসিএম-আইসিপিসির কথা বলা যায়। মর্যাদাপূর্ণ কনটেস্ট প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা হিসেবে পরিচিত এটি। এই প্রতিযোগিতার মূল পর্বে অংশ নেয় বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিম। বাংলাদেশে আগামী বছর এটির মূল পর্ব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে। এর পুরো অবদান জামিলুর রেজা চৌধূরীর। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রযুক্তি শিক্ষায় এগিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতার আসর আয়োজন করতে পারেনি। জেআরসির ভাগ্য হলো না, দেশে হতে যাওয়া এই প্রতিযোগিতা দেখে যাওয়ার। সোজা কথা, এসব কনটেস্টের মাধ্যমে তিনি আমাদের শিক্ষার্থীদের আরও সম্ভাবনাময়ী করে তোলার নেতৃত্বে ছিলেন।
কিছুদিন প্রযুক্তি বিটে সাংবাদিকতা করার কারণে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা এসাইনমেন্টে দেখেছি, জেআরসি তাঁর বক্তব্যে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতেন না। নতুন কারও সঙ্গে পরিচয় হলে আগ্রহ নিয়ে কথা বলতেন, বিস্তারিত জানার। এটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক মনে করি। কারণ এতে পরস্পর বোঝাপড়া ভালো হয়। ছিলেন তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, ৯৬-এ। সে সময় চালু হয় দেশের ইন্টারনেট সেবা। তাঁর ক্যারিয়ারের যুগান্তকারী মাইলফলক এটি।
আর একটা বিষয় লক্ষ্য করলে পরিস্কার হবেন, তিনি কিন্তু বিএনপি, আওয়ামী লীগ―দুইটি সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। দুইটি দলই যখন ক্ষমতায় এসেছে, গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে জেআরসির সহায়তা নিয়েছে। দেশে সাধারণত এই দুই দলের সঙ্গে একই ব্যাক্তির কাজ করার সুযোগ মেলে না। জামিলুর রেজা চৌধুরী এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম। আমার কাছে মনে হয়েছে, মূলত তিনি কাজের দিকে ফোকাসড থাকায় দুইটি দলই তাদের সরকারের সময় জেআরসির সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠে আসে। যেহেতু তিনি রাজনীতিকে ডিল করেছেন এবং দুই সরকারসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাঁর পাণ্ডিত্ব হাজির করেছেন, সর্বোপরি দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের ক্রাইসিস মোমেন্টে তাঁর ভয়েস/পর্যবেক্ষণ কী? এই পয়েন্টে জামিলুর রেজা চৌধুরী ভূমিকা রাখতে পারতেন নিঃসন্দেহে। হয়তো ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরাগভাজন হতেন। তাতে কী আসে যায়? এইখানেও তাঁর ভূমিকা দেশের দরকার ছিল। জণগণের জন্য। তাহলে জেআরসির জীবন আরও বর্ণাঢ্যময় হতো।
আর তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানী একদিন নোবেল পাবেন। সো বিজ্ঞানকে দেশে এগিয়ে নিয়ে যেতে, তাঁর থেকে প্রকৃত প্রস্তাব পাওয়া যেতে পারত। যেহেতু তিনি দীর্ঘদিন এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। বিজ্ঞান, গবেষণায় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবহেলা নিয়ে তাঁর ভয়েস থাকলে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী একদিন নোবেল পাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যেত। দেশের কম্পিউটার আন্দোলন, বেসিসের প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও তিনি যুক্ত। এটা স্বীকার করতে হয়, দেশের প্রযুক্তিখাতের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জেআরসি জড়িত ছিলেন। করোনাকালে তাঁর প্রস্থান হলো। বড্ড অসময়। পরপারো ভালো থাকুক দেশের এই মেধাবী সন্তান।
মিশুক চৌধুরী : লেখক