রবিবার, ডিসেম্বর ৮, ২০২৪

ট্যাক্সি চালিয়ে ক্রিকেট খেলা জামাল এখন পাকিস্তানের নায়ক

ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি জীবিকার তাগিদে একসময় ট্যাক্সি চালাতেন, হতাশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াতেও, এখন সেই অস্ট্রেলিয়াতেই টেস্ট অভিষেকে আলো ছড়ালেন পাকিস্তানের পেস বোলিং অলরাউন্ডার আমের জামাল।

by ঢাকাবার্তা ডেস্ক
ট্যাক্সি চালিয়ে ক্রিকেট খেলা জামাল এখন পাকিস্তানের নায়ক

খেলা ডেস্ক।।

টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকেই অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায় ৬ উইকেট। পাকিস্তান ক্রিকেটের ৫৯ বছর আগের এক স্মৃতি ফেরানো। আমের জামালের অভিষেক অনেকটা যেন রূপকথার মতোই। তবে তার জীবনটা কোনো রূপকথা নয়! বরং অনেক পরিশ্রম আর প্রতিজ্ঞা, অনেক ঘাম-শ্রম-ত্যাগ এবং হাল না ছাড়া মানসিকতায় স্বপ্নের পিছু ছুটে লড়াইয়ের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তবেই আজকের ঠিকানায় আসতে পেরেছেন ২৭ বছর বয়সী এই পেস বোলিং অলরাউন্ডার।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চলতি পার্থ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়েছেন জামাল। টেস্ট অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ায় ৫ উইকেট শিকারের কীর্তি ছিল আগে ছিল পাকিস্তানের আর একজন বোলারের। ১৯৬৪ সালে মেলবোর্নে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন আরিফ বাট।  সব দেশ মিলিয়ে সফরকারী বোলার হিসেবে অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ায় ৬ উইকেট নেওয়ার স্বাদ পেয়েছেন এই দুজন ছাড়া আর মোটে একজন বোলারই। ১৯৬৭ সালে অ্যাডিলেইডে ৬৭ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন ভারতের সৈয়দ আবিদ আলি।

ট্যাক্সি চালিয়ে ক্রিকেট খেলা সেই জামাল এখন পাকিস্তানের নায়ক।। ঢাকাবার্তা।।

ট্যাক্সি চালিয়ে ক্রিকেট খেলা সেই জামাল এখন পাকিস্তানের নায়ক।। ঢাকাবার্তা।।

অথচ একটা সময় নিজ দেশে ক্রিকেটের পথে কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিলেন না জামাল। হতাশায় একসময় পাড়ি জমালেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে ক্লাব ক্রিকেটে ভালো শুরুও করলেন। কিন্তু নিজ দেশে খেলার তাগিদে আবার ফিরে এলেন দেশে। কিন্তু ফেরার পর ক্রিকেট ও জীবনের কঠিন বাস্তবতায় স্বপ্নগুলো মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা!  তিনি তবু হাল ছাড়লেন না। জীবন সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন ক্রিকেটের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে। একসময় জীবনও তাকে ফিরিয়ে দিতে থাকল। প্রতিদানের সেই পালায় আজ তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটের আলোচিত নাম।

 

টেস্ট অভিষেকের আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ তিনি পেয়ে গেছেন। গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে পাকিস্তান দলে অভিষেক তার। প্রথম ম্যাচে একটি উইকেট পেলেও সেই সিরিজে আরেকটি ম্যাচ খেলে উইকেটশূন্য থাকেন খরুচে বোলিংয়ে। বাদও পড়ে যান। পরে গত পাকিস্তান সুপার লিগের শেষ দিকে দারুণ পারফরম্যান্স দিয়ে আবার নজর কাড়েন। গত অক্টোবরে এশিয়ান গেমসের পাকিস্তান দলে জায়গা পান। কিন্তু হংকং ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ খেলেও উইকেট পাননি। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তার পারফরম্যান্সকে মূল্যায়ন করা হয়েছে বলেই সুযোগ পেয়ে যান অস্ট্রেলিয়া সফরের টেস্ট দলে।

ট্যাক্সি চালিয়ে ক্রিকেট খেলা সেই জামাল এখন পাকিস্তানের নায়ক।। ঢাকাবার্তা।।

ট্যাক্সি চালিয়ে ক্রিকেট খেলা সেই জামাল এখন পাকিস্তানের নায়ক।। ঢাকাবার্তা।।

পাকিস্তানের টেস্ট দলে তিনি ডাক পেয়েছিলেন আগেই। গত জুনেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের দলে জায়গা হয়েছিল তার। সেবার অবশ্য খেলার সুযোগ পাননি। তবে সেই সময়টাতেই তার জীবনের গল্প শুনিয়েছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। তখনই জানান, বয়সভিত্তিক পর্যায়ের পর তাকে ক্রিকেটে টিকে থাকতে লড়তে হয়েছে অনেক।

“২০১৪-১৫ সময়টায় আমি পাকিস্তানে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে খেলেছি। এরপর প্রায় বছর চারেক খুব বেশি ক্রিকেট খেলতে পারিনি। ২০১৮ সালে আমার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এর আগে দুই-এক মৌসুমে ‘গ্রেড টু’  খেলেছি। সেখানেও এ-এক ম্যাচ খেলানো হয়েছে, কারণ সেভাবে পরিচিতি ছিল না আমার। ওই সময়টায় খুব হতাশ ছিলাম আমি।”

গ্রেড টু ক্রিকেট খেলার সময়ই হুট করে তার সামনে সুযোগ আসে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ক্লাব ক্রিকেট খেলার।

“আমাদের ক্লাবে একটি ছেলে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া থেকে। সে আমাকে একদিন বলল, ‘তোমাকে অনেক পরিশ্রম করতে দেখেছি, সময় নষ্ট করতে দেখিনি। তোমাকে কাগজপত্র পাঠিয়ে দেব, অস্ট্রেলিয়ায় এসে খেলো। অভিজ্ঞতাও হবে, পারলে সেখানে থিতুও হয়ে যাবে।’ আমি সেভাবে গুরুত্ব দেইনি। কতজনই তো এরকম বলে থাকেন!”

“একদিন ঠিকই সে কাগজ পাঠাল। ক্লাবের সঙ্গে আমার কথা হলো। সেখানে গিয়ে খেললাম। ওই মৌসুম খুব ভালো কাটল আমার। ওই মৌসুম চলার সময়ই জানতে পারলাম পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দলের কোনো সফর আছে। ক্লাবকে বললাম যে আমি যেতে চাই। কারণ, পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসা তো হৃদয় থেকে চলে যায়নি!”

দেশের ক্রিকেটের প্রতি টান, দেশের হয়ে খেলার তাড়না তাকে আবার ফিরিয়ে আনল পাকিস্তানে। অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হওয়ার হাতছানিকে উপেক্ষা করে ফিরে তো এলেন বটে, কিন্তু ফেরার পর শুধু ক্রিকেটে নয়, জীবনযুদ্ধেও নামতে হলো তাকে।

অভিষেকে ৫৬ বছর আগের স্মৃতি ফেরালেন আমের জামাল।। ঢাকাবার্তা।।

অভিষেকে ৫৬ বছর আগের স্মৃতি ফেরালেন আমের জামাল।। ঢাকাবার্তা।।

“ক্লাবের শেষ কিছু ম্যাচ রেখে  ফিরে এলাম পাকিস্তানে। তখন ‘গ্রেড টু’ মৌসুমের কিছু ম্যাচও ছিল। ভাবলাম যে ওসব ম্যাচে খেলব। কিন্তু তারা আমাকে সুযোগ দিল না, দলেই রাখল না।”

“এরপর আমি ব্যাংক থেকে লিজ নিয়ে একটি গাড়ি নিলাম। কারণ, ঘর তো চালাতে হবে! আমিই পরিবারের সবচেয়ে বড় ছিলাম। পরিবার অতটা ক্রীড়াপ্রেমী ছিল না যে ইচ্ছেমতো খেলতে দেবে। তাছাড়া ক্রিকেট খুব বেশি খেলতেও পারছিলাম না। তাই গাড়ি লিজ নিলাম।”

জীবিকার তাগিদে নাম নিবন্ধন করলেন তিনি অনলাইন ট্যাক্সি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু ক্রিকেটের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না! ক্রিকেটের পথে টিকে থাকতেই কঠিন ছকে নিজের প্রতিটি দিন বেঁধে ফেললেন তিনি।

 

“তখন আমার রুটিন এরকম হয়ে গিয়েছিল যে, সকাল ৫টায় উঠে ফজরের নামাজ পড়েই অনলাইন হয়ে যেতাম। সকাল ১০টা–সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সময়টায় অফিস, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময়। ওই চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালাতাম। এরপর ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা বোলিং করতাম। বিশ্রাম নিতাম না। স্রেফ লাঞ্চ করে নিতাম। এরপর নামাজ পরে যেটুকু সময় থাকত, কিছুটা ব্যাটিং ও ফিল্ডিং করতাম।”

“আবার দুপুর দুইটা বা তিনটা থেকে অনলাইন হতাম। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আবার গাড়ি চালাতাম, ওই সময়টায় অফিস, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শেষে সবাই বাড়ি ফিরত। বাকি রাইডগুলো ওই সময় শেষ করতাম। সাতটার পর এক ঘন্টা সময় বের করতাম ফিটনেস নিয়ে কাজ করার জন্য। ছয়টা থেকে সাতটা বা সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত এক ঘণ্টা জিম করতাম। এরপর আবার অনলাইন হয়ে যখন ঘরে ফিরতাম, প্রায়ই বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়ত। কখনও কখনও পথেই যা পেতাম, খেয়ে ফেলতাম।”

এই যে অধ্যাবসায়, স্বপ্ন পূরণের আই লড়াই বিফলে যায়নি। ক্রমে ঘরোয়া ক্রিকেটের মূল স্রোতে ঢুকে পারফর্ম করেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে লম্বা স্পেলে বোলিং করার পরিচিতি গড়ে তুলেছেন। এমনকি টানা ১৭ ওভার বোলিংয়ের অভিজ্ঞতাও তার আছে! পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটে নানা সময় তাকে বিশ্রাম দিতে চেয়েছেন কোচরা। কিন্তু জাতীয় দলে খেলার তাড়নায় একটি ম্যাচও বসে থাকতে চাননি তিনি। পাকিস্তান দলের নেটেও দিনের পর দিন বোলিং করেছেন নিজেকে সমৃদ্ধ করতে। একটু একটু করে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন। সব কিছুর ফল মিলতে শুরু করেছে।

টেস্ট অভিষেক কেবলই নতুন আর একটি শুরু। সামনের চ্যালেঞ্জ আরও অনেক কঠিন। তবে সেই কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার বিশ্বাসও জামালের আছে। জীবনই তাকে শিখিয়েছে লড়াই করে টিকে থাকতে।

“লড়াই করার মাধ্যমে আমি সময়ের মূল্য শিখেছি। কোনো জিনিসের যে মূল্য আছে… কোনো কিছু অর্জন করে নিলে সেটির মূল্য বেশি। পরিশ্রম ছাড়া কোনো কিছু পেয়ে গেলে সেটির মূল্য থাকে না। আমার পথচলায় এটা শিখতে পেরেছি যে, জীবনে ‘শর্টকাট’ বলে কিছু নেই। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু পেলে সেটিকে ততটাই মূল্যবান মনে হয়, যতটা লড়াই করে তা পাওয়া যায়।”

“আমাকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে জীবনে। অভিজ্ঞতা থেকেই শিখেছি এবং এজন্য কোনো সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতে চাই না।”

 

আরও পড়ুন: রোহিতের জায়গায় মুম্বাইয়ের নতুন অধিনায়ক হার্দিক

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net