সোমবার, জানুয়ারি ২০, ২০২৫

ট্রাভেল ট্যুর প্যাকেজের নামে কোটি টাকার প্রতারণা

মূলত তাকওয়া ট্রাভেলস নামে ওই ট্রাভেল এজেন্সিটি ছিল ভুয়া। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাদের মতো নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি। এসবের ভিড়ে কোনটা ভালো, আর কোনটা মন্দ তা বোঝা বেশ কঠিন

by ঢাকাবার্তা ডেস্ক
ট্রাভেল ট্যুর প্যাকেজের নামে কোটি টাকার প্রতারণা

বাণিজ্য ডেস্ক।।

সপরিবারে সৌদি আরবে ওমরা করতে ট্রাভেল ট্যুর এজেন্সি খুঁজছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী হাফিজুল ইসলাম (৩৭)। এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে একদিন ‘তাকওয়া ট্রাভেলস’ নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সির খোঁজ পান। যারা অল্প খরচে ওমরাসহ দুবাইতে প্যাকেজে ঘোরার সুযোগ দিচ্ছে। এমন অফার দেখে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করেন ওই ট্রাভেল এজেন্সির স্বত্বাধিকারী সাইফুল আলমের (৩৫) সঙ্গে। যোগাযোগ করে এ বিষয়ে কথা বললে সাইফুল আলম তাকে আকর্ষণীয় হোটেলসহ প্যাকেজের বিভিন্ন ছবিসহ তথ্য হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেখান। এসব দেখে হাফিজুল ওই ট্রাভেল এজেন্সির ফাঁদে পড়েন, হারান লক্ষাধিক টাকা।

মূলত তাকওয়া ট্রাভেলস নামে ওই ট্রাভেল এজেন্সিটি ছিল ভুয়া। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাদের মতো নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি। এসবের ভিড়ে কোনটা ভালো, আর কোনটা মন্দ তা বোঝা বেশ কঠিন। ঝামেলা ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণ করতে ভ্রমণপিপাসুরা দ্বারস্থ হচ্ছেন এজেন্সিগুলোতে। আর সেই সুযোগটি নিচ্ছে কিছু ভুয়া ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সি। অনলাইনে লোভনীয় অফার দিয়ে ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছে তারা। ভ্রমণের নামে লোকজনদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব চক্র। সম্প্রতি এই চক্রটির খোঁজ পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

সংস্থাটি বলছে, চক্রটি রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় অফিস খুলে ২৬টি ফেসবুক পেজ এবং কয়েকটি ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে অল্প দামে ট্যুর প্যাকেজ বিক্রির নামে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছে। গত এক বছরে চক্রের হাতে দুই শতাধিক ব্যক্তি প্রতারিত হয়েছেন। এ সময়ে তারা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা।

ভুক্তভোগী হাফিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ফেসবুকে একদিন একটি পেজে কথা হয় তাকওয়া ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী সাইফুল আলমের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে তার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী, গত ২৮ নভেম্বর বিকালে রাজধানীর কলাবাগানে তার প্রতিষ্ঠানে যাই। সেখানে গিয়ে আলোচনা শেষে ওমরার জন্য ১০ রাত এবং দুবাইয়ের তিন রাত ট্যুর বাচ্চাসহ চার জনের চুক্তি হয় ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭০০ টাকা। ওই দিনই আমি পাসপোর্টের ফটোকপিসহ ২০ হাজার টাকা বুকিং মানি দিয়ে আসি। এর একদিন পরই সাইফুল আমাকে বলেন, সবকিছু রেডি হয়ে গেছে, আরও টাকা দিতে হবে। পরে আরও ১ লাখ ৩৫ হাজার মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার দেই। এই টাকা নেওয়ার পর সাইফুল আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। কল করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অফিসে গেলেও তাকে পাওয়া যায় না। পরে উপায় না পেয়ে আমি কলাবাগান থানায় এ বিষয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করি।’

সাইফুল আলমের মতো প্রতারণার শিকার হয়েছেন—এমন আরও অনেকের মধ্যে আরেকজন ভুক্তভোগী মোস্তাকিম হোসেন। তিনি ও তার বাবা ওমরা করার জন্য এভাবে ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সাইফুলের কাছে। কিছু দিন পর জানতে পারেন ওমরার জন্য যাকে টাকা দিয়েছেন, তিনি একজন প্রতারক। মোস্তাকিম বলেন, ‘ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। কথাবার্তা বলে প্রথমে বিশ্বাস না করে উপায় নেই। পরে আমি ও বাবা ওমরা করতে যাবো বলে টাকা জমা দেই। আমি ব্যাংকে লেনদেন করতে চেয়েছিলাম। তবে সে কৌশলে তার কর্মচারীকে দিয়ে নগদ টাকা নেয়। ঠিক এক সপ্তাহ পরে আমি আর তার খোঁজ পাইনি। ফোন দিলে বন্ধ পাই। পরে শুনেছি ভুয়া ট্রাভেল এজেন্সি খুলে তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে।’

 

রাজধানীর গুলশান এলাকার বাসিন্দা জুঁই আক্তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত একটি কলেজে পড়াশোনা করেন। সম্প্রতি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মালদ্বীপে যাওয়ার জন্য ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ‘ট্রিপকার্ড’র সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কম মূল্যে ভ্রমণের আকর্ষণীয় প্রাইজ দেখে আকৃষ্ট হন জুঁই। এরপর ভিসা ও অন্যান্য খরচের জন্য ৫৫ হাজার টাকা দেন। এর কিছু দিন পর দেখতে পান ট্রিপকার্ডের অফিস বন্ধ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তারা অফিস ছেড়ে চলে গেছে। নানাভাবে চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করতে পারেননি।

মামলায় বাদী উল্লেখ করেন, চলতি বছরের ১৯ আগস্ট ফেসবুকের মাধ্যমে কক্সবাজারসহ মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডে ট্যুর প্যাকেজের বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়ে আসছিল ট্রিপকার্ড। পরে কম টাকায় বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার জন্য তিন বন্ধু মিলে ট্যুর প্যাকেজে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও দুবাই যাওয়ার জন্য বুকিং দেন। এ জন্য কয়েক দফায় ব্যাংক ও নগদে প্রায় ৩ লাখের বেশি টাকা দেন তারা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুরতে যাওয়ার জন্য টাকা দেওয়ার পরও বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয় না। বরং নানাভাবে কালক্ষেপণ করতে থাকে ট্রিপকার্ড। এমনকি টাকা চেয়ে যোগাযোগ করলে কথিত ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক বাদীকে হত্যার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে অফিসসহ যোগাযোগের সব নম্বর বন্ধ করে দেয় তারা।

মামলার তদন্তে নেমে পর্যটকদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে প্রতারণায় জড়িত চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা হলো, প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুল আলম ওরফে অপু, তার ভাই মো. আহাদ আলম ওরফে তালহা এবং প্রতিষ্ঠানের কথিত অ্যাডমিন অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম।

এ প্রসঙ্গে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের ইনচার্জ ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফউল্লাহ বলেন, ‘ট্যুরে যাওয়ার জন্য বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত টাকার পরিমাণের ৪০ শতাংশ টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে বুকিং নিতো চক্রটি। বুকিং মানি প্রতারকরা নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করতো। পরে বিভিন্ন দেশের ট্যুর প্রসেসিংয়ের জন্য অফিসে ডেকে ট্যুর প্যাকেজের সম্পূর্ণ টাকা নিতো। এভাবে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়ে মোবাইল বন্ধ করে অফিস পরিবর্তন করে ফেলতো।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ট্রিপকার্ড নামের কথিত এই ট্যুর অপারেটর ফেসবুকে বিভিন্ন পেজের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতো। তারা বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় ভিসা, দিন-রাতে থাকা, হোটেল বুকিং, এয়ারপোর্ট পিকআপ-ড্রপ, গাইড লাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের ট্যুর প্যাকেজ ঘোষণা করে। একসঙ্গে ৪০ জনের ভিসা ও বিমানের টিকিট কাটাসহ সব দায়িত্ব নিজেরাই করার আশ্বাস দেয়। মূলত তারা কম টাকায় সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্য ঢাকার গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডিসহ অভিজাত এলাকায় অফিস নিতো। এক এলাকায় অফিস খুলে কিছু মানুষের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করে অফিস বন্ধ করে দিয়ে গাঢাকা দিতো। এরপর কিছু দিন পর আত্মগোপনে থেকে ভিন্ন নামে আরেক এলাকায় একই কাজ করতো।’

মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘যেকোনও ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। আকর্ষণীয় ও কম মূল্যের বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ না হয়ে সেবা নিতে হবে বৈধ লাইসেন্সধারী ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে। কোনও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির মাধ্যমে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হলে থানায় মামলা বা অভিযোগ দিতে হবে।’ এছাড়া নিজের পাসপোর্ট কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net