আরিফ খান সাদ ।।
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে ‘তাবলীগ’ একটি পরিচিত শব্দ। তাবলীগ শব্দের অর্থ প্রচার করা। মহান আল্লাহ তার নবীকে ইসলাম ধর্মের তাবলিগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সে ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে যুগে যুগে আলেম-মাশায়েখগণ ইসলাম ধর্মের তাবলীগ করে আসছেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্ম প্রচারে কাজ করে যাচ্ছে তাবলিগ জামাত। অন্যান্য আন্দোলনের মতো তাবলীগ জামাতও ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের অবদান। দেওবন্দ মাদরাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্র মাওলানা ইলিয়াস আখতার কাসেমী কান্ধলভীর (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.) হাত ধরে ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তাবলীগ জামাত। দেওবন্দ মাদরাসার প্রথম ছাত্র শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দীর কাছে ১৯০৮ সালে বুখারি ও তিরমিজি পড়েন মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী। তার সহপাঠী ছিলেন মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী, মাওলানা ইবরাহীম বালয়াবী রহ. প্রমুখ। ১৯১০ সালে তিনি শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে ভারতের উত্তর প্রদেশে সাহরানপুর মাদরাসায় মাসিক ১৩ টাকা বেতনে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। সাহরানপুর মাদরাসায় তিনি ১০ বছর পাঠদান করেন হাদীসের কিতাব ‘তিরমিজি’, ‘মুয়াত্তা মালেক’, ‘মুস্তাদরাকে হাকেম’; ফিকহের কিতাব ‘কানযুদ্দাকায়েক’, ‘নুরুল আনওয়ার’; আরবী সাহিত্যের কিতাব ‘মাকামাতে হারীরী’ ও মানতেকের কিতাব ‘কুতবি’ ইত্যাদি।
মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী ছিলেন ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আন্দোলন ‘রেশমী রুমাল আন্দোলনে’র অংশীদার ও প্রত্যক্ষদর্শী। ১৯১৫ সালে শাইখুল হিন্দের বিশেষ কাফেলার সদস্য হয়ে হজের সফরে যান মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী। এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল একইসঙ্গে পবিত্র হজ পালন এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার গোপন আন্দোলন, যা রেশমী রুমালের পত্র মারফত আফগান-তুর্কি খেলাফতের সঙ্গে ভারতবর্ষের আন্দোলনের চুক্তি-বার্তা-সন্ধি ইত্যাদি চালাচালি হচ্ছিল। সফরের পূর্বে শাইখুল হিন্দ ঘোষিত খেলাফত আন্দোলনে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী শাইখুল হিন্দের হাতে বাইয়াত হন এবং ঘরে সঞ্চিত সমুদয় সম্পদ আন্দোলনের ফান্ডে দান করে দেন; তার স্ত্রীও মোহরানা বাবদ প্রাপ্ত স্বর্ণালঙ্কার খুলে দান করে দেন। রেশমী রুমাল আন্দোলনের সে অভিযাত্রায় তারা আরবে গিয়ে অবস্থান করেন মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানীর বাসায়। পবিত্র হজ পালন শেষে তারা মাওলানা মাদানীর বাসভবনে চলমান থাকে রেশমী রুমাল আন্দোলন। বৃটিশদের কাছে গোয়েন্দা মারফত গোপন সংবাদে রেশমী রুমাল আন্দোলন ফাঁস হয়ে গেলে শাইখুল হিন্দ ও হুসাইন আহমাদ মাদানীকে গ্রেফতার করে মাল্টার জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়; আর তিনি নিঃসঙ্গ অবস্থায় ভারতে ফিরে আসেন।
তাবলীগ জামাতের সূচনা হয় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার এলাকায়। প্রাচীনকালে অঞ্চলটি ছিল ‘মেও’ জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি। বর্তমানে গোরগাঁও, আলোর, ভরতপুর ও মথুরার কিছু অংশ নিয়ে মেওয়াত এলাকা বিস্তৃত। ‘তারিখে ফিরোজশাহী’তে জানা যায়, আর্যদের আগমনের বহু পূর্ব থেকে মেও গোষ্ঠীরা এই এলাকায় বসবাস করত। তাদের আচার-আচরণ ছিল বহু ক্ষেত্রে আরব জাহেলিয়াতের কাছাকাছি। দিল্লির সুলতানি আমলেও মেওয়াতিরা বনজঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে লুটপাট করত। ১২৬০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন মেওয়াতি দস্যুদের শায়েস্তা করতে এক বড় অভিযান পরিচালনা করেন। এমন একটি এলাকা থেকেই তাবলিগ জামাতের বিস্ময়কর সূচনা হয়।
শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বড় বোনের স্বামী মির্জা ইলাহি বখশ ছিলেন ব্রিটিশদের আস্থাভাজন। তিনি নিজামুদ্দিন দরগাহ এলাকায় নির্মাণ করেছিলেন তার বাংলোবাড়ি এবং একটি মসজিদ। বাংলোবাড়ির নামানুসারে মসজিদের নাম হয় বাংলাওয়ালি মসজিদ, যা বর্তমানে ‘নিজামুদ্দিন তাবলিগ মার্কাজ মসজিদ’ নামে পরিচিত। মির্জা ইলাহি বখশের পুত্রদের গৃহশিক্ষক এবং বাংলাওয়ালি মসজিদে ইমাম হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন মাওলানা ইলিয়াছ কান্ধলভীর বাবা মাওলানা ইসমাইল। ১৯২০ সালে মসজিদের ইমাম মাওলানা ইয়াহইয়া ইবনে ইসমাইল মৃত্যুবরণ করলে শূন্য পদের জন্য এলাকাবাসী পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য মাওলানা ইলিয়াছ কান্ধলভীর কথা চিন্তা করেন। এলাকাবাসীর অব্যাহত তাগিদে সাহরানপুর মাদরাসা থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে যান নিজামুদ্দিন মসজিদ-মাদরাসার দায়িত্ব পালনে।
তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। মূলত পাঁচ বছর নিজামুদ্দিন মাদরাসা পরিচালনা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রতিফল হিসেবে জন্মলাভ করে তাবলিগ জামাত। মেওয়াতের লোকজন ধর্মানুরাগী হলেও ছিল ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে চরম উদাসীন, জাতিগতভাবে অশিক্ষিত ও মূর্খ, দুর্বল বিশ্বাসী ও কুসংস্কারপ্রিয়। জাতির শেকড় থেকে শিখর সংস্কারের প্রয়োজন অনুভব করেন মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী। এমতাবস্থায় ১৯২৬ সালে তিনি হজের সফরে যান। হজের এ সফরেই তার অন্তরে অঙ্কুরিত হয় তাবলিগ জামাতের স্বপ্নের বীজ। হজ শেষে মদিনায় নবীজির রওজার সামনে মুরাকাবায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ‘কাশফ’ হয় প্রচলিত তাবলিগ জামাতের সুরত। ১৯২৭ সালে হজ থেকে ফিরে সাবেক কর্মস্থল সাহরানপুর মাদরাসায় গিয়ে মুহতামিম মাওলানা খলিল আহমাদ সাহরানপুরি, শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভী ও প্রধান মুফতি কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী প্রমুখ আলেমের বৈঠকে উপস্থাপন করেন কাশফের বিষয়। তারা তাবলিগের নতুন এ পদ্ধতি পছন্দ করেন ও সম্মতি দেন। তাদের স্বীকৃতি নিয়ে এলাকায় ফিরে শুরু করেন তাবলিগ ও ধর্ম প্রচারের কাজ।
প্রায় ১০ বছর এলাকায় তাবলিগের কাজের অভিজ্ঞতার পর ১৯৩৩ সালে তৃতীয়বার হজের সফরে যান মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী। হজ শেষে ২৭ এপ্রিল মদিনায় নবীজির রওজায় পুনরায় মোরাকায় আত্মসমাহিত হন। তখন তাবলিগ জামাতের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে আরও গভীর বোধ অর্জন করেন এবং নতুন করে বিন্যস্ত ও পরিমার্জনা করেন। তখন তার নির্দেশে ছাত্র মাওলানা ইহতিশামুল হাসান কান্ধলভী ও মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী রচনা করেন তাবলিগি নেসাব, তাবলিগি উসুল ও ছয় সিফাত, পুস্তিকা ওয়াহেদ ইলাজ ইত্যাদি। হজ থেকে ফিরে মেওয়াতের লোকদের জামাত বানিয়ে মেওয়াতের বাইরে বিভিন্ন জেলা ও প্রদেশের মাদরাসা, খানকা, উলামা-মাশায়েখদের এলাকায় পাঠানো শুরু করেন। অল্প সময়ের ব্যবধানেই তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম মেওয়াতের মহল্লা থেকে ভারতের সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে তাবলিগ জামাতের প্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় উত্তর প্রদেশের গোরগাঁও জেলায় মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার প্রাঙ্গণে। এ ইজতেমায় জুমার নামাজের ইমামতি ও বয়ান করেন দেওবন্দ মাদরাসায় মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর দাওরায়ে হাদিসের সহপাঠী মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী।
তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠা লাভের পেছনে পাঁচজন আলেমের ভূমিকা অনস্বীকার্য- ১. সাহরানপুর মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা খলিল আহমাদ সাহরানপুরি, ২. শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলভী ৩. প্রধান মুফতি কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী। মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর সহপাঠী মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী এবং ৫. হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.। মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর সঙ্গে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯১২ সালে মাওলানা কান্ধলভীর বিয়ের খুতবা দেন মাওলানা থানভী। পরে সেটা ‘ফাওয়ায়েদে সোহবত’ নামে প্রকাশিত হয় ও বিপুল সমাদৃত হয়। মাওলানা থানবীর নির্দেশেই বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন তার ছাত্র ও খলিফা মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ফরিদপুরী তার ছাত্র মাওলানা আবদুল আজিজকে দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে পাঠান হাতে-কলমে কাজ শিখে আসতে। চার মাস প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পর লালবাগ কেল্লার পশ্চিমে খান মুহাম্মদ মৃধা মসজিদে স্থাপন করেন তাবলিগ জামাতের অস্থায়ী কেন্দ্র। তারপর রমনা পার্কসংলগ্ন নবাবি আমলে নির্মিত মালওয়ালি মসজিদে (বর্তমান কাকরাইল মারকাজ মসজিদ) স্থাপিত হয় স্থায়ী কার্যালয় (১৯৫২ সালে এর বর্তমান নকশা করেন স্থপতি আব্দুল মুকিত)। দুই বছর পর ১৯৪৬ সালে ঢাকা সফরে আসেন তৎকালীন প্রধান জিম্মাদার মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী। সে বছরই কাকরাইল মসজিদে হয় বাংলাদেশের প্রথম ইজতেমা। ১৯৬৭ সালের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশাল ময়দানে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টঙ্গী ময়দানের ১৬০ একর জমি তাবলিগ জামাতের নামে বরাদ্দ দেন। সে ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা।
লেখক : সহসম্পাদক : সময়ের আলো