শনিবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৫

তিস্তায় ভারতের আগ্রহে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি

by ঢাকাবার্তা
খালেদ সাইফুল্লাহর কলাম

খালেদ সাইফুল্লাহ ।। 

আগামী ২১ ও ২২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপাক্ষিক ভারতে সফরের কথা রয়েছে। শেখ হাসিনার এ সফরের জন্য ভারতের প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণ পৌঁছে দিতে ৮-৯ মে ঢাকা সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা। কোয়াত্রার এই সফরের পরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গন নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। যদিও কোয়াত্রার এই সফর হওয়ার কথা ছিলো ২০ এপ্রিল।  ভারতের লোকসভা নির্বাচনের কারণে সে সফর স্থগিত হলেও নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই কোয়াত্রা বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাড়াহুড়ার এই সফরের এক ফাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নে ভারতের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেন তিনি।

ভারত যে এই প্রকল্পে অর্থায়নের আগ্রহ দেখাবে সেটা বাংলাদেশের কাছে অপ্রত্যাশিতই ছিলো। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ প্রকল্পটি নিয়ে এগোলেও ভারতের আপত্তির কারণেই সেটি দীর্ঘায়িত হচ্ছিলো। তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প-টিআরসিএমআরপি নামে এই প্রকল্পটি তিস্তা নদীর পানি সংকট নিরসনে বাংলাদেশ চীনের সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ডিজাইন করেছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকার এই ‘মাস্টার প্ল্যান’ গ্রহণ করে। এর আগে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন অব চায়না (পাওয়ার চায়না) এই প্রকল্পের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। প্রকল্পটি তিস্তা অববাহিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের জল সমস্যার একটি বিকল্প সমাধান হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছিলো।

তিস্তা ব্যারেজ, হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট।

তিস্তা ব্যারেজ, হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট।

এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তরে তিস্তার ১১৫ কিলোমিটার জুড়ে খননকাজের মাধ্যমে নদীর তলদেশের গভীরতা বৃদ্ধি করে নাব্যতা ধরে রাখা। নদীর উভয় তীরে ১০০ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বাঁধের উপর চার লেনের রাস্তা নির্মাণের পাশাপাশি বিভিন্ন পয়েন্টে বেশকিছু সেতু ও সড়ক নির্মাণও এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া সারা বছর পানির চাহিদা পূরণের জন্য জলাধার নির্মাণও এ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিলো।

প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭২৫.০৯ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের জন্য চীনকে প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অনুরোধে ২০১৯ সালে তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও শুরু করে চাইনিজ কর্পোরেশন। এরপর চীনের পক্ষ থেকে প্রকল্প প্রস্তাবটি বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরও করা হয়েছে। তৎকালীন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিংও তখন তিস্তা বহুমুখী প্রকল্পে চীনের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। ২০২২ সালে রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের নেতৃত্বে চীনা দূতাবাসের ৩ সদস্যের একটি দল লালমনিরহাটের তিস্তা ব্যারেজ এলাকা পরিদর্শন করে।

প্রস্তাব মূল্যায়নের পর, চীন এ প্রকল্পটির জন্য তার সর্বোচ্চ প্রধান্যের আশ্বাস দিয়েছে, তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন আশা প্রকাশ করেছিলেন যে ১২ তম জাতীয় নির্বাচনের পরে তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। ফলে ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাবটি এমন একটি সময়ে এলা যখন বাংলাদেশ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের সাথে একটি চুক্তি সম্পন্ন করার দ্বারপ্রান্তে।

ভারতের সাথে দীর্ঘ আলোচনায় কোনো ফলপ্রসূ ফলাফল না পাওয়ায় বাংলাদেশ তিস্তার পানি সমস্যার বিকল্প সমাধান করতে বাধ্য হয়েছে। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে দাবি করা ভারত বাংলাদেশের পাশে না থাকায় চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবে যেহেতু পরিকল্পিত তিস্তা প্রকল্পটির অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও ‘চিকেন নেক’-এর কাছাকাছি, তাই শুরু থেকেই এ প্রকল্পে ভারতের আপত্তি ছিল। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই করিডরের কাছাকাছি চীনের উপস্থিতি ভারতের জন্য নিরাপত্তা উদ্বেগ সৃষ্টি করে। যদিও বাংলাদেশ বা ভারত কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে এটি স্বীকার করেনি। তবে এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে ভারতের উদ্বেগের ফলে বাংলাদেশ চীনের সাথে প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগিয়েছে।

এর পাশাপাশি অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ ক্রমাগত চীনের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করে ভারত। তাদের মতে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য এটি চীনের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যা ভারতের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ বারবারই বুঝিয়েছে চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক হলেও ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক কৌশলগত। সাম্প্রতিক বছরেগুলোতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়েছে। উভয় দেশ ইতোমধ্যে বাণিজ্য ও সংযোগ সহজ করার জন্য বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ভারত-অর্থায়নকৃত আগরতলা-আখাউড়া রেল সংযোগ এবং খুলনা-মংলা রেল সংযোগের লক্ষ্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণ নির্বিঘ্ন করা। এছাড়া স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পণ্য পরিবহনকে সহজ করতে বাংলাদেশ ভারতকে বহুমুখী ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাও দিয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশই একে অপরকে ’সত্যিকারের বন্ধু’ এবং বিশ্বস্ত প্রতিবেশী বলে আখ্যায়িত করে। অথচ তিস্তা অববাহিকাজুড়ে বসবাসকারী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী যে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে তার পেছনে রয়েছে ভারত। তিস্তা প্রকল্পে ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাব বিকল্প সমাধান হিসেবে এ প্রকল্পের অগ্রগতিকেও স্থবির করে দেবে। পানি বণ্টন চুক্তি ও বহুমুখী প্রকল্প উভয়টিই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ার ফলে এই প্রস্তাব বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগকে দীর্ঘায়িত করবে। এই প্রস্তাব থেকে বোঝা যায় ন্যায্য পানি বন্টনের আলোচনা থেকে সরে যেতে চায় ভারত। ভারত যদিও পানি বন্টন চুক্তির স্থবিরতার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দায়ী করে, তবে ভবিষ্যতেও কেন্দ্রীয় সরকার যে এই চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী নয় এই প্রস্তাবের মাধ্যমে পক্ষান্তরে তা-ই বুঝিয়ে দিলো। তবে বাংলাদেশ অবশ্য তিস্তার উজানের পানির ন্যায্য অংশ নিশ্চিত করার জন্য তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, যা প্রকল্পের ধীর গতির একটি প্রধান কারণ।

খরাপ্রবন তিস্তা অববাহিকায় বসবাসকারী জনগণের চলমান দুর্ভোগ নিরসনে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় একটি সহযোগিতামূলক এবং টেকসই পদ্ধতি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় ভারত এই প্রকল্প থেকে চীনকে সরিয়ে নিজেরা অর্থায়নের যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে তা বাংলাদেশকে আরও জটিল ভূরাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে ফেলে দেবে। ফলে এ প্রকল্পের ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলা করতে তিস্তার পানির ন্যায্য বণ্টন ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই সবচেয়ে টেকসই সমাধান হতে পারে। বিশাল বিনিয়োগ, পরিবেশগত ও পরিবেশগত ঝুঁকি এবং প্রকল্পের সফলতার হার বিবেচনায় এটিই হতে পারে বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম সমাধান।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও গবেষক

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net