সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম ।।
নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যক্রমে এবং আব্বা, মাা’র দোয়াতে বৈচিত্র্যময় জীবন আমার অথবা বলা যায় মহান আল্লাহর অসীম রহমতের বরকতে জীবনের যে কোনো বৈচিত্র্য কে আমি ইতি বাচক মানষিকতা নিয়ে সবসময় সাদরে গ্রহন করি, তার ভিতর থেকে শিক্ষা গ্রহন করি, জীবনকে উপভোগের করি!
১৯৮৯ সাল থেকে মাত্র তারুণ্যে পৌঁছানো আমি জীবনের যে বৈচিত্র্যময় গতিময়তার মধ্যে আমার নতুন জীবন শুরু করেছিলাম যা এখন অবধি চলমান তার সব কিছু আমার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, আমার সন্তান এবং তাদের সন্তানদের জন্য লিখে রাখতে চাই। জীবন উপলব্ধি গুলি সবার সাথে শেয়া করতে চাই।
আমার জীবনের অন্য রকম বৈচিত্র্য শুরুর ভূমিকা যেখান থেকে শুরু –
১৯৭৩ সালের ২৬শে মার্চ গোপালগঞ্জে আব্বার মৃত্যুর পর আমার শান্ত শৈশবে স্কুল শেষে বাসায় ফিরে নিঃসঙ্গ মা’কে প্রায় সারাক্ষণ সংগ দিতে চেষ্টা করতাম! রাতে মা’র পাশে শুয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতাম “মা, আমি কিন্তু বড় হলে কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা, আমি কোনোদিন ও বিয়ে করবো না, আমি সারাজীবন তোমার কাছে থাকবো ৷ লেখাপড়া শেষ করে বড় চাকুরী করবো তখন তোমাকে নিয়ে আমি ঢাকা থাকবো!” মা’ দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলতেন “তোমাকে ছেড়ে থাকা আমার জন্য ও অসম্ভব মা’, তুমি অল্প বয়স থেকেই অনেক দায়িত্ববান মেয়ে আমার… কিন্তু বিয়ে তো করতেই হবে, তোমার বড় বোনদের ১৫/১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তোমার ও সেই বয়স পার হলেই বিয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে…
( ১৯৭৯ সাল- আমার বিয়ের তিন বছর হবার আগেই মা’ ১৯৮৩ সালে ইন্তেকাল করেন। সারা জীবন ধরে নিজেকে অপরাধী মনে হয়, স্বার্থপরের মত মাকে একা ছেড়ে এসেছিলাম! মা’র জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট সারা হৃদয় জুড়ে আছে।)
বড় বোনদের মতই ১৬ বছর বয়স পার হতে না হতেই বিভিন্ন সার্ভিস থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে, সব প্রস্তাব আমি যথারীতি না’ বলে দেই। তখন মাঝে মাঝেই ঢাকা/চিটাগাং বেড়াতে আসি বড় বোন বা সেঝো বোনের বাসায়, কখনো মা সাথে থাকেন, কখনো আমি একা, বড় বোনেরা আমার বিয়ের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে, কখনো তাঁরা আমার বিয়ে নিয়ে প্রায় হতাশ হয়ে যান…! মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান আমাকে নিয়ে! অবশেষে মা’ কে আমি আস্বস্ত করি এই বলে যে আব্বা তাঁর মেয়েদের জন্য “ম্যাজিস্ট্রেট” পাত্র পছন্দ করতেন তুমিও তাই পছন্দ করো সুতরাং আমি “ম্যাজিস্ট্রেট” ছাড়া বিয়ে করবো না, তবে গোপালগঞ্জ পোস্টিং এমন কোনো ম্যাজিস্ট্রেট আমি বিয়ে করবো না! (আমি গোপালগঞ্জে বীণাপানি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পাস করে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সরকারী মহাবিদ্যালয় থেকে এইচ এসসি পাস করে তখন গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হয়েছি।)
এরই মধ্যে ১৯৭৯ সালের কোনো একসময় ঢাকা বেড়াতে আসলে আমার বোনদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁদের সাথে তাঁদের এক নিকট বন্ধু জনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে বুঝতে পারি সেখানে অনাড়ম্বর ভাবে পাত্র / পাত্রী দেখার আয়োজন করা হয়েছে। বোনদের মাধ্যমে বিষয় টি জানতে পেরে আমি কিশোরী সুলভ আচরনে বেঁকে বসি – আমার সাথে কেউ কথা বলতে পারবেনা। আমাকে দেখতে হলে কথা না বলে দূরে বসে দেখতে হবে… বোনেরা আস্বস্ত করে বলে ” কেউ কথা বলবে না তোর সাথে, তুইও পাত্র কে দূর থেকে ভালো করে দেখে নে, পাত্র তোর ইচ্ছো অনুযায়ী ‘ ম্যাজিস্ট্রেট “! পাত্র কে ইশারায় আমাকে চিনিয়ে দিয়ে আমার দুই বড় বোন ( বড় আর সেঝো) / আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে সবার সাথে মিশে গিয়ে স্বাভাবিক গল্পে যোগ দেন!
লম্বা ড্রয়িং রুমের এক দিকে পুরুষরা আর একদিকে মেয়েরা বসে স্বাভাবিক গল্প করছিলেন আর আমি চরম অস্বস্তি নিয়ে টেবিলে পড়ে থাকা একটি ম্যাগাজিনের পাতার পর পাতা উল্টিয়ে সময় পার করার চেষ্টা করছিলাম আর ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে পাত্র দেখার চেষ্টা করছিলাম!
পাত্রের আচরনে আমি বিমোহিত হয়ে যাই এই কারনে যে উনি একবার ও আমাকে তাকিয়ে দেখছিলেন না। এক মূহুর্তের জন্যও আমাদের চার চোখ এক হয়নি…।
বাসায় ফেরার পথে বোনেরা, দুলাভাই , ভাই সবাই বার বার জিজ্ঞেস করছিলেন পাত্র পছন্দ হয়েছে কিনা৷ আমাকে তাঁরা পাত্রের বায়োডাটা মুখে মুখেই বলে যাচ্ছিলেন…” পাত্র ১তম বি সি এস কর্মকর্তা ( ১৯৭৩ ব্যাচ, এডমিন ক্যাডার) মুক্তি যোদ্ধা, ঢাকা বিশব্বিদ্যালয় থেকে ফিজিক্স আর আইন ( ল’) দুই টি সাবজেক্টে একসাথে পড়েছে, খুব ভালো ছাত্র , এসএসসি থেকে শুরু করে সব কিছুতে first class….. শুধু বয়সে আমার থেকে একটু বেশি বড়ো ( ১১/১২ বৎসর ব্যাবধান) চাকুরীতে ইতিমধ্যে ৭ বছর পার করে ফেলেছেন…।
নিরিহ, সোজা, সরল আমি পাত্রের বয়ো ডাটা শুনে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে আমার । আস্তে মিনমিনে গলায় বলি ” পাত্র তো আমাকে দেখেননি এখনো, আগে দেখুক তারপর উনি উনার মতামত জানালে আমিও আমার মতামত জানাবো “। বোনেরা কিছুটা রাগত্ব স্বরে বলে ” তোর মতামত তুই আগে জানা পাত্রের মতামত পরে জানা যাবে “! আমি মতামত জানিয়ে বলি যে পাত্র নিঃসন্দেহে খুব ভদ্র কারন তিনি একবার ও আমার দিকে তাকিয়ে দেখেননি…!!
বাসায় ফিরে সিড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে উঠতে একটানা টেলিফোনের রিংটোন শুনতে পাই , সেঝো বোন প্রায় দৌড়ে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই অপর দিক থেকে কিছু একটা বলতেই তিনি খুশিতে ” আলহামদুলিল্লাহ ” উচ্চারন করে বলেন পরবর্তী পরিকল্পনা আমি সবার সাথে আলাপ করে জানাচ্ছি…।
ফোন রেখে তিনি আনন্দের সাথে জানান যে পাত্রের পাত্রী পছন্দ হয়েছে। পাত্রীর যদি পাত্র পছন্দ হয় তাহলে দু এক দিনের মধ্যে এনগেজমেন্ট করে ফেলতে চান কারন পাত্র কে দুই এক দিনের মধ্যে ছুটি শেষে তাঁর কর্মস্থলে
” মেহেরপুর ” ফিরে যেতে হবে…।
বোনের কথা আমাকে অবাক করে দেয় – তিনি দেখলেন কখন আর পছন্দ করলেন কখন কিছুই বুঝতে পারলাম না !!
(পরে জেনেছিলাম তিনি আমরা সেই বন্ধুর বাসাতে ঢোকার সময়ই একনজরে দেখে নিয়েছিলেন আর বাকিটা দেখেছেন আমার অলক্ষ্যে রুমের ওয়ালে সেট করা বড় লুকিং গ্লাসের ভিতর দিয়ে…।
(তিনিই অবশেষে আমার স্বামী জনাব এ এফ এম সাইফুল ইসলাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সচিব, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার । তাঁর মেধার নাগাল পাওয়া আমার মত মেধাহীন মানুষের জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার! তলাহীন সেই মেধার সাগরে মেধাহীন আমি শুধু হাবুডুবু ই খেয়েছি সারা জীবন , ক্লান্ত আমি সেই মেধার অতল সাগর হাতড়ে বেড়ানো ছেড়ে দিয়েছি।
বুদ্ধি, রুচি, জীবন যাপন পদ্ধতিতে বিপরীতমুখী আমরা দুই জন! তিনি সব কাজ হাত দেন “eleventh hour এ – আমি সব কাজে সময় নিয়ে বুঝেশুনে পা বাড়াতে পছন্দ করি।
তিনি ভয়ানক ব্যস্ততা, তাড়াহুড়া পছন্দ করেন –
আমি সবকাজ ঠান্ডা মাথায় জেনে বুঝে করা পছন্দ কবি!
বাচ্চাদের তিনি শাসন করা পছন্দ করেন – আমি আদর দিয়ে লালন করা পছন্দ করি…!
তিনি কঠোর কঠিন বস্তু বাদী – আমি আবেগ প্রবন প্রকৃতি প্রেমি!
তিনি আধুনিক প্রযুক্তির প্রতি আকৃষ্ট – আমি প্রাচীনকে আকড়ে রাখতে পছন্দ করি।
তিনি বাস্তববাদী – আমি নস্টালজিক… ।
অবসরে তিনি টক- শো দেখে সময় কাটান – আমি রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে ঘর সাজাতে পছন্দ করি !
কোনো একসময় কোনো একদিন এক সৌখিন Astrologer কে আমাদের পরিচয় গোপোন রেখে আমি আমাদের জন্ম মাস এবং তারিখ ইত্যাদি দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম এই দুই জনের বিবাহ সম্পর্ক কতোটা সুখের হবে,? তিনি কি জানি সব দাগ কেটে হিসাব নিকাশ করে জানিয়ে দিলেন ” এই দুই রাশি র একত্রে মিলন অসম্ভব , আমি নিশ্চিত ভেবে নিয়ে ছিলাম আমার স্বামীর স্কুলে দেয়া জন্ম সাল আর তারিখ আসল নয় !
(এগুলো সব পরবর্তীতে সারাজীবনের উপলব্ধি। )
পাত্র পাত্রী দেখা পর্বের ২ দিনের মধ্যে আমাদের মা’র অনুপস্থিতিতে ‘এনগেজমেন্ট’ পর্ব শেষ হয়। মা’কে গোপালগঞ্জ টেলিগ্রাম করে জানানো হয় এবং দ্রুত ঢাকা চলে আসতে বলেন। তখন গোপালগঞ্জে আমাদের বাসায় কোনো ফোনের কানেকশন ছিলোনা কিন্তু গোপালগঞ্জ কৃষি ব্যাংক এর শাখা ছিলো আমাদের বাসার একদম পাশে এবং ব্যাংক এর ম্যানেজার সপরিবারে আমাদের বাসায় ভাড়াটিয়া হিসাবে ছিলেন। বোনেরা তাঁর অফিসে ফোন করে নিয়মিত মা’র খোঁজ নিতেন। সেখানে ফোন দিয়েও আমার এনগেজমেন্ট এবং বিয়ের বিষয়ে মা’কে জানানো হয়। মা বিয়ের সমস্ত আয়োজন নিজে পরিকল্পনা করে প্রয়োজনীয় আর্থিক বল, জনবল সহ ১০/১২ দিনের মধ্যে ঢাকা চলে আসেন…!!
(চলবে)
লেখক : সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম
এ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ