ঢাকাবার্তা ডেস্ক ।।
‘পেট্রোডলার’ শব্দটি প্রথমে শুনে মনে হতে পারে এটি কোনো মুদ্রা। তবে পেট্রোডলার মূলত পেট্রোলিয়াম বা খনিজ তেল রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত মার্কিন ডলারকেই বোঝায়। অর্থাৎ, যখন কোনো দেশ তেল বিক্রির বিনিময়ে মার্কিন ডলার গ্রহণ করে, তখন সেই ডলারগুলো পেট্রোডলার নামে পরিচিত হয়। পেট্রোডলার বিশ্ব অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
পেট্রোডলারের উৎপত্তি ও প্রেক্ষাপট
১৯৭০-এর দশক ছিল বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য এক উত্তাল সময়। ১৯৭৩ সালে মিসর ও সিরিয়ার নেতৃত্বে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা ‘ইয়োম-কিপ্পুর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষ নেওয়ায় আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রোলিয়ামের সংকট সৃষ্টি হয় এবং ডলারের বিনিময় হার হঠাৎ কমে যায়।
এই সংকট মোকাবিলার জন্য ১৯৭৪ সালের ৮ জুন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে পেট্রোডলার চুক্তি সই হয়। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, সৌদি আরবের কাছ থেকে তেল কিনবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পরিবর্তে সৌদি আরবকে সামরিক সহায়তা দেবে তারা। চুক্তির শর্ত ছিল, সৌদি আরব শুধুমাত্র মার্কিন ডলারে তেল বিক্রি করবে এবং পেট্রোডলার থেকে যে রাজস্ব আয় হবে, তার একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রকেও পাঠাবে।
পেট্রোডলারের প্রভাব
পেট্রোডলার চুক্তি বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশ্বব্যাপী তেলের লেনদেন মার্কিন ডলারে হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এছাড়া, পেট্রোডলার চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে ডলারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
বর্তমান পরিস্থিতি
সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘ পাঁচ দশকের পেট্রোডলার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং সৌদি সরকার সেই চুক্তি নবায়নে আগ্রহী নয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে সৌদি আরব এখন থেকে শুধু ডলার নয়, অন্যান্য দেশের মুদ্রায়ও খনিজ তেল বিক্রি করতে পারবে। চীনের ইউয়ান, ইউরোপের ইউরো, রাশিয়ার রুবল, জাপানের ইয়েন—যেকোনো মুদ্রায় লেনদেন করতে পারবে দেশটি। এছাড়া, সৌদি আরব ক্রিপ্টোকারেন্সিতেও লেনদেন করার পরিকল্পনা করছে।
ভবিষ্যৎ পরিণতি
পেট্রোডলার চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় সৌদি আরব একভাবে মুক্ত হয়ে গেল। এখন সৌদি আরব স্বাধীনভাবে বিভিন্ন মুদ্রায় তেল বিক্রি করতে পারবে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের প্রাধান্য কমাতে সাহায্য করবে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিতে এর প্রভাব কতটা হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রকে এখন আন্তর্জাতিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং চীনের প্রাধান্য খর্ব করতে আরও উদ্যোগী হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন চীন। ডলারের রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।