ঢাকাবার্তা ডেস্ক ।।
সৌদি আরব দীর্ঘ পাঁচ দশকের পেট্রোডলার চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে। সম্প্রতি এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও, সৌদি সরকার সেই চুক্তি আর নবায়ন করতে আগ্রহী নয়। এর ফলে ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
১৯৭৪ সালের ৮ জুন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে পেট্রোডলার চুক্তি সই হয়েছিল। ৯ জুন তার মেয়াদ শেষ হয়। ভূরাজনীতির পরিবর্তিত বাস্তবতায় সৌদি আরব সেই চুক্তি নবায়ন করতে আর আগ্রহী নয়। নাসডাক ডটকম সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যেভাবে ডিডলারাইজেশন প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে, এ চুক্তির নবায়ন না হওয়া তার পালে আরও হাওয়া দেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এই চুক্তির বদৌলতে বিশ্ববাণিজ্যে মার্কিন ডলারের ব্যবহার বেড়েছিল।
‘পেট্রোডলার’ শব্দটা শুনে মনে হতে পারে, এটি কোনো মুদ্রা। আসলে পেট্রোলিয়াম বা খনিজ তেল রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত মার্কিন ডলারকেই পেট্রোডলার বলা হয়। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সোনা আদান–প্রদানের নীতি বাতিল করার পর পেট্রোডলার চালু করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৭০-এর দশক ছিল বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতির উত্তাল সময়। সত্তরের দশকের শুরুর দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা ধাক্কা খায়। ডলারের বিনিময় হার হঠাৎ কমতে শুরু করে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রোলিয়ামের সংকটও তৈরি হয়েছিল।
১৯৭৩ সালে মিসর ও সিরিয়ার নেতৃত্বে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ইয়োম-কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের পক্ষ নেওয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানির বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে পশ্চিম এশিয়ার তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো। এতে তাদের খনিজ তেলের ভান্ডারে আরও টান পড়ে।
এই সংকট মোকাবিলায় সৌদি আরবের সঙ্গে পেট্রোডলার চুক্তি করেছিল ওয়াশিংটন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, সৌদি আরবের কাছ থেকে তেল কিনবে যুক্তরাষ্ট্র আর তার পরিবর্তে সৌদি আরবকে সামরিক সহায়তা দেবে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পাওয়ায় সৌদি আরব অনেকটা চিন্তামুক্ত হয়; ইসরায়েলের হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে। চুক্তির শর্ত ছিল, সৌদি আরব শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্য যেসব দেশের কাছে তেল বিক্রি করবে, তার লেনদেন হবে মার্কিন ডলারে।
চুক্তিতে আরও বলা হয়েছিল, পেট্রোডলার থেকে যে রাজস্ব আয় হবে, তার হিস্যা যুক্তরাষ্ট্রকেও পাঠাতে হবে। এর মাধ্যমে সৌদি আরব এক দিকে সামরিক সুরক্ষা পেয়েছিল, আরেক দিকে যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছিল অর্থনৈতিক নিরাপত্তা।
বর্তমান পরিস্থিতি
পেট্রোডলার চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় সৌদি আরব এখন থেকে শুধু ডলার নয়, অন্যান্য দেশের মুদ্রায়ও খনিজ তেল বিক্রি করতে পারবে। চীনের ইউয়ান, ইউরোপের ইউরো, রাশিয়ার রুবল, জাপানের ইয়েন—যেকোনো মুদ্রায় লেনদেন করতে পারবে দেশটি। এছাড়া, সৌদি আরব ক্রিপ্টোকারেন্সিতেও লেনদেন করবে।
প্রভাব
সৌদি আরবের এ সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা ধাক্কা খাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের লেনদেন অনেকটা কমবে। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার কিছুটা প্রাধান্য হারিয়েছে। একের পর এক দেশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসছে বা আসার চেষ্টা করছে। যদিও ডলারের বিকল্প হিসেবে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের মুদ্রা এককভাবে উঠে আসেনি, তবে ইউয়ান, রুবল কিংবা ইয়েনের ব্যবহার পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
বিশ্ববাণিজ্য এখনো অনেকাংশে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার মূল হাতিয়ার হলো ডলার। বেশির ভাগ লেনদেনের ক্ষেত্রেই সারা বিশ্বে মার্কিন ডলার ব্যবহার করা হয়। এই মুদ্রা দিয়ে সারা বিশ্বের অর্থব্যবস্থার নাটাই নিজেদের হাতে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ডলারের বিনিময় হার বাড়ল না কমল, তার ওপর বিশ্ব অর্থনীতির অনেক কিছু নির্ভর করে।
ভবিষ্যত পদক্ষেপ
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডলারের হৃত গৌরব ফেরাতে আন্তর্জাতিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। চীনের প্রাধান্য খর্ব করতে আরও উদ্যোগী হতে হবে। কারণ, এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে চীন।
সৌদির সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের কতটা ক্ষতি হবে, এখনই তা বলা যাবে না। তবে ডলারের রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে কি না বা তার জন্য তাকে কোন কোন ক্ষেত্রে নমনীয় হতে হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।