স্টাফ রিপোর্টার ।।
রাস্তার প্রায় মাঝখান দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলেছেন ফারহান নামের এক শিক্ষার্থী। পাশে দাঁড়ানো ভ্যানের দোকান এড়িয়ে, আরেকপাশে চলমান রিকশা পাশ কাটিয়ে প্রায় উল্টো দিক ধরে হাঁটছেন। পাশে গিয়ে নিচু স্বরে ‘ফুটপাতে হাঁটেন না কেনো ভাই’ বলতেই চটে গেলেন। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘ফুটপাত। মাঝ রাস্তা পর্যন্ত তো দোকানে ভরা। তারপরও চেষ্টা করেছি। কিন্তু এত ধীরে হাঁটলে পরীক্ষাটা মিস করবো।’ আলাপ শেষ না হতেই প্রায় ঝড়ের গতিতে রাস্তা পার হয়ে চলে গেলেন।
একসময় ফুটপাতে দোকান, সেই দোকান কারা বসায়, কারা ওঠায় তা নিয়ে বিস্তর আলাপ হলেও এখন এসব গা সওয়া হয়ে গেছে রাজধানীবাসীর। সবাই জানে, বেশিরভাগ সড়কের ফুটপাতই ভাসমান ব্যবসায়ীদের দখলে। এরা কাউকে না কাউকে টাকা দিয়ে জায়গা নেয়। এর সঙ্গে ঠিক কারা জড়িত, তা বলতেও চান না এই দোকানিরা। কিন্তু সব ছাপিয়ে এখন বড় হয়ে দেখা গেছে যে প্রশ্ন— এর শেষ কোথায়? পথচারীদের ফুটপাতে হাঁটতে বলছি, কিন্তু সেখানে জায়গা নেই। রাস্তার পাশ ধরে হাঁটবেন, সেই উপায় নেই। তাহলে তারা আসলে করবেনটা কী? বাধ্য হয়েই অনেকসময় ঝুঁকি নিয়ে সড়ক দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে পথচারীদের। যদিও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী বলছে, তারা সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছে।
কী করছেন তারা দেখতে রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, পান্থপথ ও মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার বিভিন্ন সড়কে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অচলপ্রায় ফুটপাতের চিত্র। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে পথচারীদের চলাচল দিনদিন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়তই পড়তে হচ্ছে নানান বিড়ম্বনায়। রাজধানীর গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, গোলাপ শাহ মাজার, স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকার রাস্তার ফুটপাতগুলো যেন ক্রমেই সরু হয়ে চলেছে। এতে বাধ্য হয়েই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল করছেন তারা।
এদিকে গোলাপ শাহ মাজারের পূর্বদিকের কোনায় মূল সড়কে দেখা যায়, সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়ার গাড়ি। তারা তাদের সিরিয়াল অনুযায়ী দাঁড়িয়ে ছিলেন যাত্রীর অপেক্ষায়। তবে তাদের মূল সড়কে দাঁড়ানোর কথা ছিল না। কারণ সেখানে ঘোড়ার গাড়ি রাখার নির্ধারিত স্থান রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের থেকে একটি সাইনবোর্ডও টানানো রয়েছে। কিন্তু সেখানে কেবল সাইনবোর্ডই আছে। ঘোড়ার গাড়ি রাখার সুযোগ নেই, বসেছে সারি সারি জুতার দোকান। আর ঘোড়ার গাড়ি মূল রাস্তায় অবস্থান করায় এখানকার যানজট বেড়েছে আরও অনেকটা।
এসময় কথা হয় ঘোড়ার গাড়ির কোচওয়ান (চালক) মো. সোলায়মান হোসেন রনির সঙ্গে। কেন তারা নির্ধারিত স্থানে গাড়ি রাখছেন না জানতে চাইলে রনি বলেন, আমাদের গাড়ি দাঁড় করোনার জন্য স্ট্যান্ড আছে। কিন্তু আমরা সেখানে দাঁড়াতে পারি না হকারদের জন্য। ওখানে দাঁড়ালে হকাররা ঝামেলা করে। তাই আমরা রাস্তায় দাঁড়াই।
ঘোড়ার গাড়ির স্ট্যান্ডের সামনে দোকান নিয়ে বসা হকারদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা এখানে এভাবেই ব্যবসা করে আসছে। দোকান এখানে দিতে নানা ‘সিস্টেম’ করা লাগে।
এদিকে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের রেলওয়ে মার্কেটের (বর্তমানে নতুন ভবন নির্মাণাধীন) সামনে ফুটপাত বলতে এখন আর কিছু নেই। ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসা আব্দুল করিম বলেন, মার্কেটে (রেলওয়ে সুপার মার্কেট) আমাদের দোকান ছিল। মার্কেট ভেঙে ফেলছে তাই আমরা ফুটপাতে ব্যবসা করছি। আবার মার্কেট হয়ে গেলে আমরা মার্কেটে দোকান দিবো।
যদিও গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে রাস্তায় চৌকি বসিয়ে জার্সি, টি-শার্ট বিক্রেতা মো. ইয়াসিন বলেন, ‘আমরা ঠিক মতো ব্যবসা করতে পারি না এখন, পুলিশ উঠিয়ে দেয়। পুলিশ দেখলে আমরা চলে যাই। আবার পুলিশ চলে গেলে আবার বসি, এভাবেই চলছে। আর পুলিশ ধরতে পারলে তো থানায় নিয়ে যায়। ৭০০ টাকা জরিমানা দিয়ে কোর্ট থেকে ছাড়া পেতে হয়। পুলিশ ছাড়তে পারে না। আর যারা ৭০০ টাকা জরিমানা দিতে না পারে তাদের ৫ দিন জেলে থাকতে হয়।’
কিন্তু সাময়িক এ ধরনের উদ্যোগে কারোর কিছু আসে যায় না। গুলিস্তানের পীর ইয়ামীনী মার্কেটের সামনে, বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের তিন পাশে, ডাক অধিদফতরের (ডাক ভবনের) পূর্ব গেটের পাশে একই চিত্র। সেখানে ফুটপাত বলে কিছুই নেই। পুরো ফুটপাতই লাগেজ, ব্যাগসহ বিভিন্ন জামা কাপড়ের দোকানের দখলে রয়েছে। এখানে ফুটপাত আছে এমনটা মনে করাই যেন দুষ্কর।
সরেজমিনে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে সেখানে দায়িত্বরত পল্টন থানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের নির্দেশ দেওয়া আছে, কোনও দোকান যেন ফুটপাতে না আসে, আমরা সেটা ফলো করি। তারপরও অনেকে বসে, আমরা সেটা উঠিয়ে দেই। ওরা পরে আবার বসে। আর এখানে ফুটপাতে ওরা অনেক আগে থেকেই বসে এভাবে ব্যবসা করে আসছে।’
ফুটপাতে কেবল কাপড় বিক্রি হচ্ছে তা নয়, ভয়াবহ গ্যাস সিলিন্ডার রেখে ফুটপাতে চলছে রেস্তোরাঁ। পান্থপথ জুড়ে বিভিন্ন খাবারের দোকানের দখলে রয়েছে ফুটপাত। কেবল ফুটপাতই নয় রাস্তায়ও প্রশস্ত হয়েছে তাদের ব্যবসা। ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসেছেন এক খাবারের ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার। রাস্তায় কেন দোকান দিয়েছে এই প্রসঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘আমরা অনেকদিন ধরেই এই রাস্তায় ব্যবসা করি। কোথাও না কোথাও তো আমাদের কাজ করে খেতে হবে, এখানেই করছি।’সিলিন্ডারের গ্যাস ঝুঁকিপূর্ণ, সঙ্গে গরম তেলের কড়াইও রয়েছে রাস্তায়; এটাও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে একথা মনে করিয়ে দিতেই তিনি বলেন, ‘এখনও কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। আর বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’
নগরীর ফুটপাত চলাচল উপযোগী করার বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের নতুন উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাস্তা ও ফুটপাতে সর্বসাধারণের চলাফেরা স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কমিশনার বিশেষ নির্দেশ নিয়েছেন। সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। ফুটপাত যাতে আবার দখল না হয়ে যায়, সে ব্যাপারেও শক্ত অবস্থানে রয়েছে পুলিশ।’
ফুটপাত ছাড়িয়ে হকাররা অর্ধেক রাস্তা দখল করেছে, এখন করণীয় কী প্রশ্নের জবাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা যতবার উচ্ছেদ করি, ততবারই তারা আবার বসে পড়ে। আমরা পুলিশের সাথে সমন্বিত পরিকল্পনা করছি। নাইট মার্কেট ও হলিডে মার্কেটের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। সেখানে বসতে কাউকে চাঁদা দিতে হবে না। সিটি করপোরেশন নিজ দায়িত্বে পরিচ্ছন্ন জায়গা করে দিবে। এরইমধ্যে প্রধান নগর পরিকল্পনাকারী কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে পরিকল্পনা করতে। আমরা উত্তরার একটি ওয়ার্ডকে মডেল হিসেবে তৈরি করতে চাই শুরুতে। একসঙ্গে এই কাজটি করতে হবে।
(বাংলা ট্রিবিউনের সৌজন্যে)