দ্য গার্ডিয়ান ।।
বিশ্বের বড় অংশের চোখেই হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন একজন যুদ্ধাপরাধী। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আমৃত্যু তাঁকে ঘিরে থাকা ক্ষমতাবৃত্তের বন্ধুরা তাঁকে গণ্য করতেন একজন যশস্বী বুদ্ধিজীবী হিসেবে।
২৭ মে ১০০ বছর পূর্ণ করেছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার। আজ তিনি শেষ নিঃশাস ত্যাগ করলেন। তবে এ পর্যন্ত তাঁকে তাঁর কৃতকর্মের জন্য বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। যদিও এখন অনেক ভাষ্যকারই তাঁর ‘নিপীড়নমূলক ও প্রাণঘাতী কৃতকর্ম’ নিয়ে মুখ খুলছেন, তবে দশকের পর দশক ধরে তিনি রাজনীতি ও মিডিয়া মহলে উচ্চকিত প্রশংসাই পেয়ে আসছেন।
নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা এক ইহুদি শরণার্থী কিশোর বিশ্বের বুকে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। দুই প্রেসিডেন্ট—রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে কাজ করা কিসিঞ্জার এক অর্থে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়েই ওঠেন।
আসলে ওই খামের ভেতর ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের একটি বক্তব্যের খসড়া, যে বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি তাঁর বাস্তববাদী রাজনীতির সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী উদারনৈতিকতার সমর্থকদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন টেনেছিলেন। বলাই বাহুল্য, নিক্সনের ওই বক্তব্য পরে কুখ্যাতি পায়।
সত্যিকার অর্থে সর্বাধিক গোপনীয় কাজ করেন হেনরি কিসিঞ্জার গত শতকের সত্তরের দশকজুড়ে, অত্যন্ত কদর্যভাবে। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি লাওস ও কম্বোডিয়ায় অবৈধ বোমা হামলার ছক কষেন এবং তার বাস্তবায়নও করেন। পূর্ব তিমুর ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) গণহত্যার পথ সুগম করেন কিসিঞ্জার।
নিক্সনের সঙ্গে কিসিঞ্জারের দহরম-মহরম এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে রুশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ দার্শনিক ইসাইয়া বার্লিন তাঁদের ‘নিক্সনজার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই ‘জুটি’ ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছাতে। উদারনৈতিক এলিটদের অবজ্ঞা করা ছিল তাঁদের লক্ষ্য।

নিক্সনের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক পাক্ষিক দ্য নেশন–এর প্রচ্ছদ
কিসিঞ্জার সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকে হেয় করেছেন। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেন অপমানজনক বিশেষণ—‘উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির কলেজপড়ুয়া বাচ্চা’। নারীদেরও অপমান করেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘আমার কাছে নারী বিনোদনের বেশি কিছু নয়, একটা শখমাত্র। আর কেউ শখের পেছনে খুব বেশি সময় ব্যয় করে না।’ তবে এত কিছুর পরও সমাজের উচ্চশ্রেণির কাছে কিসিঞ্জারের কদর ছিল।
এই কদরের ব্যাপ্তি সত্তরের দশকেই আটকে থাকেনি; ২০১৩ সালে যখন কিসিঞ্জার ৯০ বছর পূর্ণ করেন, তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় দলের কর্তাব্যক্তিরা। এই দলে ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, সিনেটর জন ম্যাককেইনসহ প্রায় ৩০০ ভিআইপি। দুই দলের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখার প্রশ্নে কিসিঞ্জারের সুখ্যাতি আছে। (সন্ধ্যায় হয়তো রিপাবলিক কন্ডোলিৎজা রাইস ও ডোনাল্ড রামসফেল্ড গেলেন কিসিঞ্জারের কাছে, পরে রাতের দিকে সেখানে হাজির হলেন ডেমোক্র্যাট হিলারি ক্লিনটন।)

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও হেনরি কিসিঞ্জার। ২০১৩ সালে এক অনুষ্ঠানে । ছবি : রয়টার্স
তবে বাস্তবতা হলো, বিশ্বের বড় অংশই কিসিঞ্জারকে গালি দেয়। সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ কয়েকটি দেশ এড়িয়ে চলেন এই ভয়ে যে তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হতে পারে এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা হতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০২ সালে চিলির একটি আদালত দেশটির সামরিক অভ্যুত্থানে (১৯৭৩) তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে জানতে কিছু প্রশ্নের জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগে ২০০১ সালে ফ্রান্সের একজন বিচারক প্যারিসে কিসিঞ্জারের হোটেল কক্ষে পুলিশ পাঠিয়েছিলেন। চিলির ওই অভ্যুত্থানের ব্যাপারে তাঁর কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছিল। ওই সামরিক অভ্যুত্থানের সময় বেশ কজন ফরাসি নাগরিক নিখোঁজ হন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে কিসিঞ্জার ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেখানে গত শতকের অন্যতম এই ‘কসাই’ ধনবান ও ক্ষমতাধরদের কাছে আদরণীয়, শ্রদ্ধাভাজন।
ফলে কিসিঞ্জার যত দিন জীবিত থাকবেন, তত দিন মার্কিন শাসনক্ষমতার বৃত্তে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যমণি হয়েই থাকবেন।
ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ হাসান ইমাম