ধর্ম ডেস্ক।।
‘বাবার বাড়ি বেড়ানো’ শেষে ‘আনন্দময়ী’ দেবী ফিরে গেলেন ‘কৈলাসের দেবালয়ে’; ঢাকের বাদ্য আর আবীর খেলায় বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হল বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় পার্বণ শারদীয় দুর্গোৎসবের।
মণ্ডপে মণ্ডপে এ উৎসবের সূচনা হয়েছিল দশ দিন আগে, মহালয়ার মধ্য দিয়ে। মঙ্গলবার সকালে বিজয়া দশমীতে ‘বিহিত পূজা’ আর ‘দর্পণ বিসর্জনে’ দুর্গা পূজার শাস্ত্রীয় সমাপ্তি হয়। বিকালে হয় প্রতিমা বিসর্জন।
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহালয়ার দিন ‘কন্যারূপে’ ধরায় আসেন দশভূজা দেবী; বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। তার এই ‘আগমন ও প্রস্থানের’ মাঝে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব।
ঢাকার ওয়াইজঘাটের বীণাস্মৃতি স্নানঘাটে বিকাল সাড়ে ৩টায় ধানমণ্ডি সার্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে দেবীকে বিদায় জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বিভিন্ন ঘাটে রাত ৮টা পর্যন্ত রাজধানীর ২৪৬টি মণ্ডপের প্রতিমা একে একে বিসর্জন দেওয়া হবে বলে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ধর্মদাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মহিষাসুর বধ করার মধ্য দিয়ে আজ বিজয়ী হয়েছেন দুর্গা মা। সে কারণেই আজ আমাদের আনন্দের দিন, আমরা উৎসব করি। জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ সবাইকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাই।”
হিন্দু পঞ্জিকা মতে, দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে (ঘোড়ায়) চড়ে এসেছেন, গেলেনও ঘোটকে চড়ে। দেবীর এমন গমন-আগমনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতার ইংগিত দেয়। রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সামাজিক স্তরে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, গৃহযুদ্ধ, দুর্ঘটনা, অপমৃত্যু বাড়ে।
ধর্মদাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এটা ভালো নয়। অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইবে। তবে শুভ শক্তির কাছে এই অশুভ শক্তি কখনো পেরে ওঠেনি।”
বিজয়া দশমীর আনুষ্ঠানিকতায় মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৩১ মিনিটে হয় দশমী বিহিত পূজা। ষোড়শপ্রচার পূজার পাশাপাশি দেবী প্রতিমার হাতে জরা, পান, শাপলা ডালা দিয়ে আরাধনা করা হয়। সবশেষে দর্পণ বিসর্জনের সময় প্রতিমার সামনে একটি আয়না রেখে তাতে দেবীকে দেখে তার কাছ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বিদায় নেন ভক্তরা। মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে প্রতিমা থেকে ঘটে এবং ঘট থেকে আবার ভক্তের হৃদয়ে ‘মাকে’ নিয়ে আসাকে বিসর্জন বলে।
শ্বশুরালয়ে ফেরার আগে দুর্গতিনাশিনী দেবী দূর্গাকে সিঁদুর, পান আর দুর্বা দিয়ে বরণ কর নেন নারী পূণ্যার্থীরা; এর মধ্য দিয়ে জরা কাটিয়ে পৃথিবী যেন শস্য শ্যামল হয়ে ওঠে, সেই প্রার্থনা করা হয়।
বিসর্জনের আগে ঢাকার মন্দিরে মন্দিরে চলে সিঁদুর খেলা আর আনন্দ উৎসব। দুপুরে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাকে করে প্রতিমা এনে জড়ো করা হয় পলাশীর মোড় ও ঢাকেশ্বরী পূজা মণ্ডপ এলাকায়।
এরপর সেখান থেকে ক্রমিক নম্বর নিয়ে শঙ্খ আর উলুধ্বনি, খোল-করতাল-ঢাক-ঢোলের সনাতনি বাদ্যের সঙ্গে আধুনিক উচ্চস্বরের সাউন্ড সিস্টেমে দেবী বন্দনার গানে গানে শোভাযাত্রা করেন ভক্তরা।
স্বল্পগতিতে চলা ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে চড়া পূজারিদের পাশাপাশি অনেকে পায়ে হেঁটে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। প্রতিমা ঘাটে নেওয়ার পর ভক্তকূল শেষবারের মতো ধূপধুনো নিয়ে আরতিতে মেতে ওঠেন। শেষে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে নৌকায় তুলে বিসর্জন দেওয়া হয়।
বিসর্জন শেষে মন্দিরে শান্তির জল নিয়ে আসা হয়; সন্ধ্যায় মণ্ডপে করা হয় আশীর্বাদ। এ বিসর্জনকে কেন্দ্র কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের কমিশনারের উপ-কমিশনান জাফর হোসেন বলেন, “প্রতিমা বিসর্জন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি নৌ-পুলিশ ও র্যাব সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন।”