বিশেষ প্রতিনিধি ।।
জাহাঙ্গীর আলম। পানি জাহাঙ্গীর এবং পিয়ন জাহাঙ্গীর হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিত। বাড়ি তার নোয়াখালীর চাটখিলের নাহারখিলে। বাবা রহমত উল্যাহ ইউনিয়ন পরিষদে কেরানি ছিলেন। সংসারে ছিল টানাপড়েন। ঠিকমতো লেখাপড়াও করতে পারেননি। ৯০ দশকে ঢাকা এসে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতেন। থাকতেন ধানমণ্ডির জিগাতলা এলাকায়। সেই সুবাদে মাঝেমধ্যেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সুধাসদনের বাড়ির সামনে যাওয়া-আসা করতেন। নিজের এলাকা থেকে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করতেন। পরে তিনি সুধাসদনের সামনে আসা দলীয় নেতা-কর্মীদের পানি খাওয়ানোর কাজ শুরু করেন।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ পাওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি নানা কাজে হস্তক্ষেপ করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েন জাহাঙ্গীর। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, বিঘায় বিঘায় জমি, গরুর খামার, মাছের ঘের, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গড়েন একের পর এক। জাহাঙ্গীরের সহায়তায় ভাগ্য বদলেছে তাদের ভাইদেরও। তারাও এখন কোটিপতি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাহাঙ্গীর শুধু অবৈধ সম্পদই অর্জন করেননি, বাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগের পদ-পদবিও। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালীর চাটখিল ও সোনাইমুড়ী আসনে নৌকার মনোনয়ন চেয়ে আলোচনায় আসেন এই জাহাঙ্গীর। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তবে শেষমেশ আর ভোট করতে পারেননি। নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা ও নোয়াখালীর নিজ এলাকায় বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ অঢেল সম্পদের মালিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নোয়াখালীর চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় একটি ৪তলা বাড়ি করেছেন জাহাঙ্গীর। বাড়ির পাশে রয়েছে ৭০০ শতক জমি। মাছের ঘের। গরুর খামার। মাইজদীর হরি নারায়ণপুরে নোয়াখালী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে আছে ৮তলা বাড়ি। সেখানেই নেতাকর্মীদের নিয়ে আড্ডা দেন। ‘যারিয়াত ভিলা’ নামের সেই বাড়িটি তার স্ত্রীর নামে বলে জানা গেছে। ধানমণ্ডির জিগাতলা কাঁচাবাজারের পাশে জাহাঙ্গীরের একটি ৬তলা বাড়ি রয়েছে। এছাড়া মিরপুর-২ নম্বর মসজিদ মার্কেটের পাশে চম্পা পারুল স্কুলের জমি দখল করে একটি ১০তলা ভবন তৈরি করেছে জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন একে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। বাড়ি নং-৫, রোড নং-৩, ব্লক-ই, মিরপুর-২। জাহাঙ্গীর আলম একে রিয়েল এস্টেটের ভাইস চেয়ারম্যান। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই কোম্পানির অনেক বিল্ডিং রয়েছে। এছাড়া উপজেলার খিলপাড়া পূর্ব বাজারে রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ। শুধু নিজ নামে নয়, সম্পদ করেছেন স্ত্রী, সন্তান, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজনদের নামেও।
জাহাঙ্গীরের যতো সম্পদ: নির্বাচনী হলফনামা থেকে জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় জাহাঙ্গীরের রয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকার সম্পদ। এর মধ্যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দু’টি দোকান, মিরপুরে সাততলা ভবন ও নোয়াখালীতে গ্রামের বাড়িতে একতলা পাকা বাড়ি রয়েছে। এদিকে জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রীর নামে আটতলা ভবন রয়েছে, হলফনামায় যার দাম দেখানো হয় ৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। মিরপুরে দু’টি ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয় ৪৪ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ২ হাজার ৩৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার দাম উল্লেখ করা হয়েছে ৭৬ লাখ টাকা। নির্বাচনী হলফনামায় জাহাঙ্গীরের স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ সাড়ে ৪ একরের মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। স্ত্রীর অকৃষিজমি আছে ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকার। হিসাবের বাইরেও তাদের রয়েছে আরও নানা সম্পদ। তার অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে ২ কোটি ৫২ লাখ এবং স্ত্রীর নামে ১ কোটি ১৭ লাখ টাকা আছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপিএস আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এফডিআর ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার। স্ত্রীর ব্যাংক স্থিতি ২৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা ও ডিপিএস ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। বন্ড ঋণপত্র স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এ রকম কোম্পানির শেয়ার আছে ৫৮ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ২৫ লাখ টাকা। জাহাঙ্গীরের নিজস্ব ৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। স্ত্রীর নামে আছে আরও ৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, একটি গাড়ি, যার দাম হলফনামায় দেখানো হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৭৫ তোলা স্বর্ণের দাম দেখানো হয় ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর স্ত্রীর স্বর্ণ আছে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকার। আসবাব ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ১০ লাখ ২৮ হাজার টাকার, স্ত্রীর নামে আছে ৯ লাখ টাকার। জাহাঙ্গীরের ব্যবহৃত পিস্তলের দাম ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। অংশীদারি ফার্মে তার মূলধন আছে ৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। স্ত্রীর ব্যবসায় মূলধন আছে ৭৩ লাখ টাকার। সব মিলিয়ে কৃষি খাতে তার বছরে আয় ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে আয় ১১ লাখ টাকা, ব্যবসা থেকে ৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের আয় ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। চাকরি থেকে ভাতা দেখানো হয় বছরে ৬ লাখ টাকা এবং অন্য উৎস থেকে বছরে আয় আরও ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।