ফারহানা আক্তার ।।
রাজধানীর হাজারীবাগে একটি মানিব্যাগের কারখানায় কাজ করেন আফসানা আক্তার। প্রতিদিন ৮-১২ঘন্টা কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখভাল করেন ছোট ভাইবোনদের। মা- বাবা চাকরী করার সুবাদে ভাইবোনদের যত্নের পাশাপাশি বাড়ির কাজ ও করতে হয়। তবুও তার মুখে হাসির কমতি নেই। চাকরী, ভাইবোনের যত্ন, বাড়ির কাজের পাশাপাশি সে মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজেও অংশগ্রহণ করেন। তার স্বপ্ন বড় হয়ে ডাক্তার হওয়া কিন্ত সংসারের অভাব তাকে তের বছর বয়সে অর্থ উপার্জন করতে বাধ্য করেছে।
রাসেল কাজ করেন মোহাম্মদপুরে একটি কাপড়ের দোকানে। প্রতিদিন কাজ শেষে বাড়ি গিয়ে মোবাইলে গেইমস খেলেন। বন্ধুদের সাথে মাঝে-মধ্যে অড্ডা দেন। পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর মা কাজ করেন অন্যের বাসায় আর সে কাজ করেন কাপড়ের দোকানে।
রানা কাজ করেন মোহাম্মদপুর একটি সবজির দোকানে। প্রতিদিন ভোর ৪টায় উঠে কাচাঁমালের আড়ৎে যেতে হয়। বাবা-মা দুইজন গ্রামে থাকে। নানীর সাথে ঢাকায় থেকে কাজ করেন রানা। রঙ্গিন সবজির মতো তারো ইচ্ছে তার জীবনটা রঙ্গিন হোক কিন্ত আর্থিক দৈন্যতা তার জীবন থেকে শৈশব কে কেড়ে নিয়েছে। এরকম শতশত রানা, আফসানা, রাসেলকে দেখা যাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মস্থলে। লেগুনার হেলপার থেকে শুরু করে খাবারের হোটেলের কাজেও এদের দেখা পাওয়া যায় অহরহ।
বাংলাদেশ শ্রম আইন (৬৩) অনুযায়ী, “শিশু” অর্থ চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই এমন কোন ব্যক্তি। বাংলাদেশ শ্রম আইন (৮) অনুযায়ী, “কিশোর” অর্থ চৌদ্দ বৎসর বয়স পূর্ণ করিয়াছেন কিন্ত আঠারো বৎসর বয়স পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো ব্যক্তি।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ৩৯(১) বলা হয়েছে যে সরকার সময় সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষণা করিবে। ৩৯(২) এ বলা আছে, সরকার কর্তৃক ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোন কিশোরকে নিয়োগ করা যাইবে না।
২০২২ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ৪৩টি তালিকা হালনাগাদ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। উক্ত প্রজ্ঞাপন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকার মধ্যে রয়েছে, দীর্ঘ সময় শব্দের মধ্যে কাজ করা, সর্বক্ষণ বদ্ধ পরিবেশে কাজ করা, গরম ও উত্তাপে কাজ করা, সিনিয়র কারিগরদের সহযোগী হিসেবে কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর বা বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাজ করা, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা সহ এরকম আরোও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
জাতীয় শিশুশ্রম ২০২২ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, শ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। ২০১৩ সালের জরিপ এর তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন শ্রমিক পরছে শিশুশ্রমের আওতায় এবং এদের মধ্যে থেকে ১০ লাখ ৬৮ হাজার জন ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘের শিশু তহবিলে ইউনিসেফ প্রকাশিত ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ জরিপ অনুযায়ী শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের ৩১ শতাংশ কাজ করতে গিয়ে আহত হয়। এর মধ্যে ৬৭ শতাংশ আহত হয় কাটাছেঁড়া ও আঘাতে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এর তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে কর্মস্থলে সহিংসতার কারণে শ্রমে নিয়োজিত ২০ শিশুর ম্যৃতু হয়েছে।
ইউনিসেফের ২০১০ থেকে ২০২৩ সালে ১০০টি দেশের মধ্যে জরিপে দেখা গেছে যে, বিশে^র ৪০ কোটি শিশু গৃহে নির্যাতনের শিকার। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু বাড়িতে শারীরীক বা মানসিক শাস্তির শিকার হয়েছে। এইসব শাস্তির মধ্যে পরে থাপ্পড় দেওয়া, অপমান করা। অন্যদিকে শারীরীক শাস্তির মধ্যে পরে শিশুকে ঝাঁকুনি দেওয়া, আঘাত করা। মানসিক শাস্তির মধ্যে পরে, ধমক দেওয়া, তার সামনে চিৎকার করে বকাবকি করা, তাকে অপদার্থ বা অলস বলে ডাকাও মানসিক শাস্তির অর্ন্তভুক্ত।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, বয়স সর্ম্পকে বলা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি শিশু নাকি কিশোর এ সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন উথাপিত হয় তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত উক্ত ব্যক্তির বয়স সংক্রান্ত প্রতয়নপত্রের ভিত্তেতে উহা নিষ্পত্তি হইবে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ৪১ (১) অনুযায়ী, কোন কিশোরকে কোন কারখানায় বা খনিতে দৈনিক পাঁচ ঘন্টার অধিক সময় কাজ করিতে দেওয়া হইবে না। ৪১ (৩) এ বলা হয়েছে, কোন কিশোরকে কোন প্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যা ৭-০০ ঘটিকা হইতে সকাল ৭-০০ ঘটিকার মধ্যবর্তী সময়ে কোন কাজ করিতে দেওয়া যাইবে না। বাংলাদেশ শ্রম আইন ৪২ অনুযায়ী, ভূগর্ভে এবং পানির নীচে কিশোরের নিয়োগ নিষেধ
বাংলাদেশে গৃহশ্রমিকের প্রায় ভাগ শিশু। এই শিশুদের মানসিক বিকাশের পাশাপাশি শারীরীক বিকাশ ঘটে কতটুকু তা নির্ধারন করা মুশকিল এ ছাড়া শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষা জন্য গৃহমালিকেরা কোন ব্যবস্থা নেন কিনা সে বিষয়ে অপারগ।
২০২৪ এর ১২ জুন শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়, “শিশু শ্রম বন্ধ করি, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করি। শিশুদের বিকাশ নিশ্চিত করণে শিশুশ্রম বন্ধ করা জরুরি কিন্ত বেশির ভাগ শিশু শ্রমে নিয়োজিত হয়, পারিবারের অর্থনৈতিক দ্যৈনতার স্বীকার হবার কারণে।
লাভলী আক্তার কাজ করেন মোহাম্মদপুরের একটি পার্লারের সহযোগী হিসেবে। সে কাজ করে তার কারণ তার মা ব্রেণ স্ট্রোক করে হাত-পা অবস হয়ে বিছানায় পরে আছে দীর্ঘদিন। লাভলী বাবা তার মায়ের এই অবস্থা দেখে আরেকটা বিয়ে করে চলে গেছে। মায়ের চিকিৎসার ভার পরেছে ১৩ বছরের লাভলীর উপরে। মায়ের অসুস্থতা লাভলীকে মানসিক হতাশার পাশাপাশি বিকাশ সাধনে বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। মাঝে মধ্যে নানার বাড়ি থেকে সহায়তা পেলেও সেটা খুবি সামান্য।
শিশুশ্রম প্রতিরোধ করতে আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন জরুরি। যখন দরিদ্র পরিবারগুলো সংসারের বোঝা একা সামাল দিতে পারেনা ঠিক তখনি উদ্ভন হয় শিশুশ্রমের। সংসারের টানা পরোনে পরে বেশির ভাগ অভিভাবক বাধ্য হয় শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজে পাঠাতে। এ ছাড়া একদল অসাধু ব্যবসায়ী শিশুদের পারিবারিক আর্থিক দুর্বলতার কথা জেনে অল্প মজুরী প্রদান করে তখন শিশুটিকে কাজে রেখে দেয়। এতে আর্থিক অবস্থা পুরোপুরি পরিবর্তন না হলেও শিশুদের শারীরীক ও মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়ে শিশুর রঙ্গীন স্বপ্ন ঘুড়ির মতো আকাশে উড়ে বেড়ায়।
ফারহানা আক্তার, শিক্ষার্থী ও উন্নয়ন কর্মী