ফারহানা আক্তার ।।
ভাড়া বাসায় ছোট্ট এক কক্ষে স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে বসবাস করেন সুলতানা। তিনি মোহাম্মদপুর বেরিবাঁধ সংলগ্ন ঢাকা উদ্যানের পোশাক তৈরির কারখানা,সাইনেস্ট গ্রুপে সিনিয়র অপারেটর পদে কাজ করতেন। শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে যেয়ে, বেশ কিছুদিন আগে তার চাকরী চলে যায়। তাঁর স্বামী চাকরী করেন ঢাকা উদ্যানের অরেক কারখানায়।
সুলতানা বলেন এক কক্ষের ভাড়া দিতে হয় ৫ হাজার টাকা, বিদ্যুত বিল আছে, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ আছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সন্তানদের পড়াশোনা ও সংসার চালানোই কঠিন। বড় ছেলে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করে, ছোটটাকেও দুইমাস হলো কাজে দিয়ে দিছি। ১ কেজি পেঁয়াজ কিনতে গেলে লাগে ৮০-১২০ টাকা। আলু ৫০-৬০ টাকা কেজি। ৫০০ টাকা নিয়ে বাজার করতে গেলে টাকার মিল পাওয়া যায় না। প্রতি মাসেই মুদি দোকানে বাকি টাকা জমতেছে।
সুলতানার মতো অধিসংখ্যক পোশাক শ্রমিকই সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে বর্তমান মজুরিতে। পণ্যের বাজারদর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এ অবস্থায় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ২৩-২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবী ও নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠনে আশাবাদী ছিল শ্রমিকেরা। মজুরি বোর্ডে মালিক পক্ষ সর্বনিম্ন ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি নির্ধারন করেছে। কতটুকু সামাল দিতে পারবে এই মজুরি বর্তমান অবস্থা।

শ্রমিক বিক্ষোভ
ঢাকা উদ্যান এলাকায় কয়েকজন পোশাক শ্রমিক ও শ্রমিকনেতার সঙ্গে কথা বলে, জানা যায় বর্তমানে জিনিসপত্রের যে দাম তাতে কোনোরকম খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটা চর্চা করে যাচ্ছি। বেতন যদি কমপক্ষে ২০-২৩ হাজার টাকা করে তাহলে হয়তো বাঁচা যাবে।
বেশ কিছুদিন যাবৎ কারখানা মালিকেরা পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে, শ্রম আইন ১৩(১) অনুযায়ী মালিকেরা বে-আইনি ধর্মঘটের কারণে কারখানার বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারেন, এমন বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকগণ কোন মজুরি পাবেন না। জানতে চাইলে শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন সেইফটি এন্ড রাইটস স্যোসাইটি (এসআরএস) নির্বাহী পরিচালক সেকেন্দার আলী মিনা বলেন, তাদের কর্মক্ষমতাটাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য জীবন ধারনের প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন, এটার উপর নির্ভর করে মজুরি নির্ধারন করা দরকার। শ্রমিকের সবচেয়ে বড় খরচ হচ্ছে বাড়ি ভাড়া। তারপর অন্যান্য খরচ। শ্রমিকরা তো সুপার শপে যেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে না। তারা স্থানীয় বাজার থেকে জিনিসপত্র কেনেন। শ্রমিকের বেতন বাড়ার সাথে সাথে এসব দোকানে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় তাই বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন-মজুরি যদি বাড়ে ১০ টাকা কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে চলে যায় ১৫ টাকা তাহলে তো আর মজুরি বৃদ্ধি করে লাভ নাই।
ঢাকা উদ্যানের এক শ্রমিকনেতা জানালেন, বাজারদর যে অবস্থা তা দিয়ে ১৫ দিনও শ্রমিকরা চলতে পারছে না। কাজের টার্গেট বাড়ানোর কারণে পুষ্টিহীনতায় শ্রমিকরা কাজে মনোযোগ বাড়াতে বাড়ছে না। এতে করে একদিকে যেমন শ্রমিকদের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে কারখানার উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। তাই কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া বাড়ানোর জন্য হলেও শ্রমিকদের পুষ্টির দিকে নজর রাখা দরকার । তাই বাজারে যদি পণ্যের দাম বাড়ে সেক্ষেত্রে শ্রমিকরা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও কিনতে পারছে না। বর্তমানের বাজারদরের পাশাপাশি যদি শ্রমিকের বেতনের ভারসাম্য করা যায় তাহলেই শ্রমিকরা উপকৃত হবে। যাতে কারখানার প্রোডাকশন বৃদ্ধি করার পাশাপাশি নিজেদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে পারে কারণ শ্রমিক বাঁচলেই কারখানা বাঁচবে তার সাথে দেশের সুনামও রক্ষা পাবে।
পুষ্টিবিদ সায়রা সরকার সুমি বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক একজন ব্যক্তির গড়ে ১৬০০-২৪০০ কিলো ক্যালরির প্রয়োজন হয় এবং কাজের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ২০০ থেকে ৬০০ কিলো ক্যালরির কম বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন শ্রমিক তাদের কাজের উপর ভিত্তি করে ক্যালরির পরিমাণ কমাতে কিংবা বাড়াতে পারেন। কিন্ত যদি ক্যালরির পাশাপাশি কাজের ভারসম্য না থাকে তাহলে সে বেশিদিন সুস্থ থাকতে পারবে না, সাথে কর্মক্ষমতাও হারাতে পারে। শারীরিক বিভিন্ন সমস্য দেখা দিতে পারে । সবচেয়ে বড় যেই সমস্য সেটা হচ্ছে শারীরীক দুর্বলতা আর অনেকদিন যদি শরীর দুর্বল থাকে তাহলে সে কাজে মনোযোগী হতে পারে না তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ স্বাস্থ্য সম্মত খাবার গ্রহণ করতে হবে সুস্থ্য থাকার জন্য। তার সাথে কর্মক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
মুন্নি আক্তার, ভাই ও বাবাকে নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। মাসে বাসা ভাড়া ৪ হাজার টাকাসহ বিদুৎ বিল, ময়লার বিল, গ্যাস বিল ও পানির বিল দিতে হয়। রান্নাঘর ও বাথরুম ব্যবহার করতে হয় আরোও চার পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে । মুন্নি আক্তার বলেন, যে মজুরি পাই, তা দিয়ে পুরো মাস চালাতেই হিমশিম খেতে হয়।

শ্রমিক বিক্ষোভ
শাহানাজ বেগম বলেন, মাস শেষে বাসা ভাড়া, বিদুৎ, গ্যাস, পানি বাবদ মজুরির বেশি অংশ তুলে দিতে হয় বাড়িওয়ালার হাতে। পাশাপাশি মায়ের ওষুধ, সাংসারিক বাজার খরচ, বোনের লেখাপড়ার খরচ দিতে হয়। মাসে যা মজুরি পাই তাতো খরচ হয় তার পাশাপাশি অনেক ধারদেনা করে চলতে হয়। প্রতিমাসের এই ধার সামাল দিতেই হিমসিম খেয়ে যাই। মাসের প্রথম দিকে মজুরি পেলে চিন্তা ঢুকে যায় কীভাবে দেনা শোধ করবো।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডির) এক গবেষণায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশের পোশাক মালিকেরা গবেষণা ও উন্নয়নে শ্রমিক প্রতি খরচ করেন মাত্র ২০৭ টাকা, যা পোশাকশিল্পের আকার-আকৃতির তুলনায় অনেক কম। পোশাকশিল্পের মালিকেরা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেন, তার খেসারত দিতে যেয়ে শ্রমিকেরা কম খেয়ে দিনের পর দিন শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, যা কোনোমতেই গ্রহনযোগ্য না।
২০১৮ সালের বাজারদর এবং বর্তমান বাজারদর এক না । সে সময়কার ডলারের দাম আর বর্তমানের ডলারের দামও এক না, তাই চলমান অবস্থার বাজারদরের কথা মাথাই রেখেই শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারন করা দরকার বলে শ্রমিকরা মনে করেন।
শ্রমিকরা তাদের পরিশ্রম ব্যায় করে এই পোশাক খাতটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাই দীর্ঘদিন একজন শ্রমিককে কর্মক্ষম রাখার জন্য এবং দক্ষ শ্রমিক ধরে রাখার জন্য মজুরি বৃদ্ধি সাথে বাজার নিয়ন্ত্রণ করাটা জরুরী হয়ে পরেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) মনে করছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ৭ লাখ ৯৩ হাজার টন বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন হতে পারে, তবে দাম বেশি থাকায় মানুষের কেনার সামর্থ্য কমছে। (সূত্র, প্রথম আলো)।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ১২ বছরে সর্বোচ্চ।
এরকম অবস্থায় শ্রামিকদের দরিদ্রতা দূর করে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য মজুরির পরিমাণ ন্যায়সম্মত করা প্রয়োজন হয়ে পরেছে, যাতে র্দীঘদিন কাজ করার পাশাপাশি শারীরিকভাবেও সুস্থ থাকতে পারে ।
ফারহানা আক্তার, ফ্রিল্যান্স লেখক