খেলা ডেস্ক।।
সংসারের হাল ধরার জন্য ইকবাল হাসান ইমনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল পরিবার। কিন্তু ভাগ্যদেবী লিখে রেখেছিল অন্য কিছু। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছেলেটি এখন বাইশ গজে পেস বোলিংয়ে ত্রাস ছড়ান। অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের পর এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় যুব বিশ্বকাপ মাতাতে প্রস্তুত এই ডানহাতি পেসার। বাংলাদেশ দলের পেস আক্রমণের অন্যতম ভরসা এখন তিনিই।
পাঁচ বছর বয়সেই ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকা ইমন হাতের কাছে বল না পেলেও মাটির দলাকে বল বানিয়ে ফেলতেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটু একটু করে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সব ধাপ পেরিয়েছেন তিনি। মা-বাবা ও মামার অনুপ্রেরণা এবং নিজের প্রথম কোচের দীক্ষা তাকে সহায়তা করেছে। তবে তার পেসার হওয়ার গল্পটা অদ্ভুত। অনূর্ধ্ব-১৯ যুব বিশ্বকাপ নিয়ে গণমাধ্যমকে সেইসব ঘটনাসহ নিজের স্বপ্নের কথা বলেছেন তিনি।

ইকবাল হাসান ইমন।।ঢাকাবার্তা।।
ইমন বলেন “অনূর্ধ্ব-১৬ দলে খেলার পর দুই বছর ক্রিকেটের বাইরে ছিলাম। টেপ টেনিস বলে খেললেও ক্রিকেট বল হাতে নেওয়ার সুযোগ পেতাম খুব কম। সেই সময় আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আব্বা-আম্মা। তাদের যুক্তি ছিল– ‘যেহেতু ক্রিকেটে আশাব্যঞ্জক কিছু হচ্ছে না, তাই দেশে থেকে লাভ নেই। বিদেশে গিয়ে বরং সংসারের হাল ধরো।’
কিন্তু পরিবারকে বুঝানো নিয়ে বলেন “আম্মা-আব্বাকে বলেছিলাম– যেহেতু চার বছর কষ্ট করেছি, আরও দুই বছর কষ্ট করে দেখি। এরপরও কিছু না হলে তোমরা যা বলবা সেটাই হবে।’ আমার কথার ওপর আস্থা রেখেছেন আব্বা-আম্মা। পরিবার থেকে যতটা সমর্থন পাওয়া দরকার, পুরোটাই আমাকে দিয়েছেন তারা। এছাড়া আমার ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে বড় মামার ভূমিকা আছে। মৌলভীবাজারে তার বাসায় দুই বছর থেকে ক্রিকেট খেলেছি। মামা আমার খোঁজখবর রাখতেন সবসময়। তিনি এখন বিদেশে আছেন।”
শিশু বয়সেই খেলা শুরুর ঘটনা নিঊএ বলেন “চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ক্রিকেট খেলা শুরু করি। গ্রামের বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতাম। তাদের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে মজার একটা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি না হলে পেসার হয়ে উঠতাম না।” অভিজ্ঞতাটি হলো “তখন আমার বয়স ৯-১০ বছর হবে। যখন গ্রামে খেলতাম, বড় ভাইরা বোলিং করতেন হাত ঘুরিয়ে আর আমি চাক মারতাম! একদিন ব্যাটিংয়ে থাকা এক বড় ভাই ঠাট্টা করে বলেন, ‘তুই তো বোলিং পারিস না, শুধু ঢিল মারিস।’ সেই ঠাট্টাই আমাকে পেসার বানিয়ে তুলেছে! সেদিন চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম পেসার হবো, গ্রামের সবাইকে পেস বোলার হয়ে দেখিয়ে দেবো। এরপর জানতে পারি, দৌড়ে এসে জোরে বোলিং করা পেস বোলিং! হাস্যকর শোনালেও এটাই সত্যি।

ইকবাল হাসান ইমন।।ঢাকাবার্তা।।
খেলার জন্য পরিবারে বকা খাওয়া নিয়ে ইমন হাসতে হাসতে বলেন ” খেলার জন্য আম্মা বেশি বকা দিতেন। মাঝে মধ্যে আমাকে খুঁজে না পেয়ে রেগে যেতেন তিনি। সন্ধ্যা গড়ানোর পরেও বাসায় ফিরতাম না। কখনও কখনও এশার আজান হয়ে যেত ফিরতে। আম্মা তখন অনেক বকাঝকা করতেন। তবে কয়েক বছর ধরে সেই পরিস্থিতি বদলেছে। এখন তারা আমাকে অনেক সাপোর্ট করেন। আম্মা-আব্বা সবসময় একটা কথাই বলেন– ‘তুই খেলতে থাক, তোর যা লাগে আমরা দেবো।’
প্রথমবার একাডেমীতে ভর্তি হওয়া নিয়ে ইমন জানান “ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ। একদিন বড় মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ক্রিকেট খেললাম। মামা খেলা দেখে বলেন, ‘তুই তো ভালোই খেলিস।’ তার বন্ধুর বয়সভিত্তিক একটি ক্রিকেট একাডেমি ছিল। মামা আমাকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দিতে আম্মাকে বললেন। খরচের কথা ভেবে আম্মা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করান মামা। এরপর মামার বাসায় থেকেই একাডেমির কোচ রাসেল আহমেদ স্যারের কাছে ক্রিকেট শেখা শুরু করি। তিনি মামার বন্ধু। মামা সবসময় বলতেন, ‘আমার বন্ধুর কাছে মনোযোগ দিয়ে ক্রিকেট শিখতে থাক, তুই বড় ক্রিকেটার হতে পারবি।’
অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া নিয়ে ইমন বলেন ” একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পর একাডেমি লিগ খেলেছি। এরধ্যে অনূর্ধ্ব-১৪ দলে ট্রায়াল দিয়ে টিকে যাই। যদিও অনূর্ধ্ব-১৬ মূল দলে সুযোগ পাইনি। এরপর দুই বছর কোনও ক্রিকেট খেলা হয়নি আমার। তখন মৌলভীবাজারে গোল্ডেন স্টার ক্লাবের হয়ে টেপ টেনিস খেলতাম। রাসেল স্যার আমাকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘যদি টপ লেভেলে যেতে চাও, তাহলে টেপ টেনিস বাদ দিতে হবে।’ তার পরামর্শে টেপ টেনিসে ক্রিকেট খেলা বাদ দেই। মাঝে যদিও ২০১৮-১৯ সালে স্কুল লিগে কাশীনাথ আলাউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে টেপ টেনিসে খেলেছি। পরে রাসেল স্যারের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনূর্ধ্ব-১৮ দলে সুযোগ পাই। প্রথম বছর স্ট্যান্ড-বাই থাকলেও অন্য এক পেসার অন্য দলে চলে যাওয়ায় সুযোগ হয় আমার। সেখানে দুই ম্যাচ খেলেই বিভাগীয় দলে সুযোগ পাই। এরপর ইয়ুথ ক্রিকেট লিগে ভালো খেলে সুযোগ পাই অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে।”
বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার পেস বোলিং কন্ডিশন কতটা সুবিধা দিবে প্রশ্নে ইমন বলেন “দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনে সবসময় পেস বোলারদের আধিপত্য থাকে। একজন পেসার হিসেবে আমারও স্বপ্ন প্রোটিয়া কন্ডিশনে ভালো করা। সেখানে বোলিং করে ব্যাটারদের কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলার মজাই আলাদা। আশা করি,দলের প্রয়োজন অনুযায়ী আগ্রাসী ভূমিকায় থাকতে পারবো।”
যুব বিশ্বকাপে লক্ষ নিয়ে বলেন “বড় মঞ্চের বড় পারফরমার হতে চাই। বিশ্বকাপে ভালো করলে সবাই আমাকে চিনবে। তখন পরের স্তরে খেলার সুযোগ হবে আমার। এশিয়া কাপে যেমন বোলিং করেছি, তাতে আমি সন্তুষ্ট। এভাবে যদি ধারাবাহিক থাকতে পারি, তাহলে যুব বিশ্বকাপে সফল হবো। সেক্ষেত্রে আমার ভালো একটা জায়গায় যাওয়া সহজ হবে। ২০২০ সালের যুব বিশ্বকাপ জয়ী দলের অনেকেই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন। আমাদের এটা অনেক উৎসাহ জোগায়। আমরা জানি, এখানে ভালো করতে পারলে জাতীয় দলে সুযোগ আসবেই। আমাদের ব্যাচ যদি বিশ্বকাপে ২০২০ সালের ব্যাচের মতো কিছু করতে পারে, তাহলে আমাদের জন্য সুযোগ বাড়বে। সবারই ব্যক্তিগত কিছু লক্ষ্য থাকবে। বিশ্বকাপে শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহক হওয়ার স্বপ্ন আমার। আর দল হিসেবে আমাদের লক্ষ্য শিরোপা জেতা।”
আরও পড়ুন: নতুন বছরে লিটন-শান্তদের ব্যস্ত সূচি