রাস্তায় শত শত প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল আর ট্রাকের ভিড়। নারী–শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালাচ্ছেন মানুষ। অনেকে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন মাইলের পর মাইল। সঙ্গে নিয়েছেন পোষা গরু, উট, ভেড়া আর গাধা। যতটুকু সম্ভব, তা নিয়েই অনিশ্চয়তার যাত্রা শুরু করেছেন তাঁরা।
এ চিত্র ফিলিস্তিনিদের, গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে। টানা সাত দিন ধরে নারকীয় বোমাবর্ষণের মধ্যে শুক্রবার গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের ‘নিজেদের নিরাপত্তার জন্য’ দক্ষিণে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে মাত্র ২৪ ঘণ্টা। এর পর থেকেই প্রাণভয়ে উত্তরাঞ্চল ছাড়তে শুরু করেছেন গাজাবাসী।
গাজার ফিলিস্তিনিদের এমন সময় এ নির্দেশনা দেওয়া হলো, যখন উপত্যকাটি ঘিরে ট্যাংকসহ ব্যাপক সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে ইসরায়েল। প্রস্তুতি চলছে স্থল অভিযানের। ইসরায়েলি বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, সামনের দিনগুলোতে গাজায় উল্লেখযোগ্য অভিযান চালাবে তারা। পরবর্তী নির্দেশনা দেওয়া হলে গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা আবার নিজ এলাকায় ফিরতে পারবেন।
তবে ইসরায়েলের এ নির্দেশনাকে ‘মিথ্যা প্রচার–প্রচারণা’ বলেছে গাজার শাসক গোষ্ঠী হামাস। গাজাবাসীকে এসব কথায় কান না দিতেও অনুরোধ করেছে তারা। হামাস নেতা বাসেম নাইম বলেছেন, ‘আমরা মাতৃভূমি ছেড়ে যাব না। সামনে দুটি পথ খোলা—দখলদারত্বকে পরাজিত করা, না হয় নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করা।’
এরই মধ্যে শুক্রবারও পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল ও হামাস। ইসরায়েল বাহিনী জানিয়েছে, গত বুধবার রাতেই গাজায় ৭৫০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে তারা। এ ছাড়া প্রথম ছয় দিনে উপত্যকাটিতে ৬ হাজার বোমা ফেলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, গাজাবাসীর ওপর চালানো হামলায় সাদা ফসফরাস ব্যবহার করছে ইসরায়েল। এর ব্যবহার গাজার বেসামরিক মানুষকে গুরুতর ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে ফেলছে।
ইসরায়েলের হামলায় পানি, খাবার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসবিচ্ছিন্ন গাজায় নিহতের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গত শনিবার হামলা শুরুর পর থেকে উপত্যকাটিতে ১ হাজার ৫৩৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত সাড়ে ছয় হাজারের বেশি। অপরদিকে হামাসের হামলায় ইসরায়েলে বিদেশি নাগরিকসহ ১ হাজার ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ৩ হাজারের বেশি। শুক্রবারও গাজা থেকে রকেট ছোড়া হয়েছে ইসরায়েলে।
‘নরকের গর্তে’ পরিণত হচ্ছে গাজা
উত্তর গাজার বাসিন্দাদের সরে যেতে ইসরায়েলের নির্দেশের বিরোধিতা করেছে জাতিসংঘ। এই নির্দেশনা প্রত্যাহারে ইসরায়েল সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে তারা। জাতিসংঘ বলছে, উত্তর গাজায় প্রায় ১১ লাখ মানুষের বসবাস। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ছাড়া এত মানুষের স্থানান্তর সম্ভব নয়।
অবরুদ্ধ গাজায় ক্রমবর্ধমান সহিংসতার জেরে উপত্যকাটি দ্রুত ‘নরকের গর্তে’ পরিণত হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে ইসরায়েলের নির্দেশকে ‘ভয়ংকর’ উল্লেখ করে ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, এই নির্দেশ গাজাবাসীকে নরকের দিকে ঠেলে দেবে।
এদিকে উত্তর গাজার হাসপাতালগুলোতে অনেক রোগী ভর্তি রয়েছেন। সেখান থেকে তাঁদের সরানো মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো বলে মনে করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মুখপাত্র তারিক জাসারেভিচ। এসব রোগীকে ছেড়ে যেতে নারাজ সেখানকার চিকিৎসাকর্মীরাও। গাজায় ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্টের মুখপাত্র নেবাল ফারসাখ বলেন, ‘হাসপাতালে আহত মানুষ, বৃদ্ধ ও শিশুরা ভর্তি। (আমরা চলে গেলে) এই রোগীদের কী হবে?’
আরও পড়ুনঃ গাজায় ইসরায়েলি স্থল হামলায় বেসামরিক হতাহত অগ্রহণযোগ্য হবে: পুতিন