সবজান্তা সমশের ।।
বাংলাদেশ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে, যা দেশের মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ জোরপূর্বক গুমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সংকল্প ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের এই পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিক মহলে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে, যা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নত করতে সহায়ক হবে এবং ভুক্তভোগী পরিবারদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম করবে।

বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেন।
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ (International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance) হলো একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা জাতিসংঘের অধীনে ২০০৬ সালে গৃহীত হয়। এর লক্ষ্য হলো জোরপূর্বক গুমের (enforced disappearance) বিরুদ্ধে লড়াই করা, যা হচ্ছে কোনো ব্যক্তিকে বেআইনিভাবে আটক বা অপহরণ করা এবং তার পরিণতির বিষয়ে তথ্য গোপন করা।
সনদে স্বাক্ষরকারী দেশের সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধা:
- আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহযোগিতা: এই সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি আন্তর্জাতিকভাবে তাদের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে যে তারা জোরপূর্বক গুমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতার পথ খুলে দেয়।
- মানবাধিকার সুরক্ষা: সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে দেশগুলি তাদের জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষায় একটি শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে, যা তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার রক্ষাকারী দেশ হিসেবে পরিচিত করে।
- বিচার ও ন্যায়বিচার: সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি জোরপূর্বক গুমের শিকারদের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে বাধ্য থাকে। এটি ভুক্তভোগী পরিবারগুলিকে ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণের অধিকার প্রদান করে।
- প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: এই সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি তাদের অভ্যন্তরীণ আইন ও ব্যবস্থাগুলি শক্তিশালী করতে পারে, যাতে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটার আগে তা প্রতিরোধ করা যায়।
অসুবিধা:
- আইনি বাধ্যবাধকতা: সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলিকে তাদের অভ্যন্তরীণ আইন ও বিধানাবলী পরিবর্তন করতে হতে পারে, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
- আন্তর্জাতিক পরিদর্শন: সনদে স্বাক্ষর করলে দেশগুলি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলির পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের অধীনে আসে, যা কিছু দেশের জন্য সংকটজনক হতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ বিরোধ: কিছু ক্ষেত্রে, সনদে স্বাক্ষর করা দেশগুলির সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে যদি দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী বা গোপন সংস্থাগুলি গুমের সাথে যুক্ত থাকে।

গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের প্রতিবাদ
সনদে স্বাক্ষর না করা দেশের সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধা:
- স্বাধীনতা: সনদে স্বাক্ষর না করা দেশগুলি আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার বাইরে থাকে এবং তারা তাদের নিজস্ব নিয়ম-কানুন ও আইন অনুসারে গুমের ঘটনাগুলির সাথে মোকাবিলা করতে পারে।
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: অনেক দেশ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে এই সনদে স্বাক্ষর করতে চায় না, কারণ এতে তাদের নিজস্ব সরকারী সংস্থাগুলির কার্যকলাপ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
- আন্তর্জাতিক চাপ থেকে মুক্তি: সনদে স্বাক্ষর না করা দেশগুলি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলির চাপ ও পরিদর্শন থেকে মুক্ত থাকে, যা তাদের জন্য একটি সুবিধা হতে পারে।
অসুবিধা:
- আন্তর্জাতিক সমালোচনা: সনদে স্বাক্ষর না করা দেশগুলি আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হতে পারে, যা তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
- মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি: সনদে স্বাক্ষর না করার ফলে ওই দেশের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে, কারণ এটি জোরপূর্বক গুমের ঘটনার শিকারদের ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে দিতে পারে।
- আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা: এই সনদে স্বাক্ষর না করার ফলে দেশগুলি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে, বিশেষ করে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে।
উপসংহার
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করা এবং না করা উভয়েরই নিজস্ব সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। স্বাক্ষরকারী দেশগুলি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি এবং মানবাধিকার সুরক্ষার সুবিধা লাভ করে, তবে তাদের আইনি ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। অন্যদিকে, স্বাক্ষর না করা দেশগুলি তাদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে, তবে তারা আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সম্মুখীন হতে পারে।