ঢাবি প্রতিনিধি ।।
ফুলেল শুভেচ্ছা, কেক কাটা, অভিবাদন জানিয়ে কথামালা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার উদ্যাপিত হলো বরেণ্য শিল্পী ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মদিন। শুভেচ্ছা আর ভালোবাসায় সিক্ত হলেন তিনি। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে প্রদর্শনী ও বইয়ের প্রকাশনারও আয়োজন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ দুপুরের পর থেকেই রফিকুন নবীর অনুরাগী আর নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের সমাগমে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। বেলা তিনটায় জয়নুল গ্যালারির দুটি অংশে মিলিয়ে আয়োজিত রফিকুন নবীর কার্টুন ও বিভিন্ন মাধ্যমের কাজের প্রদর্শনী ও জন্মদিনের উৎসবের উদ্বোধন করেন উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।
পাশের জয়নুল গ্যালারি ২–এ রয়েছে রফিকুন নবীর (রনবীর) বিখ্যাত ‘টোকাই’সহ অজস্র কার্টুন। প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলি, সামাজিক অসংগতিসহ, আন্তর্জাতিক বিষয় অবধি কত বিষয় নিয়ে কি বিপুল ভাবনা যে তিনি তাঁর অসাধারণ অঙ্কনশৈলী আর সরস ও তাৎপর্যময় বাক্যবিন্যাসে তুলে এনেছেন, তা প্রকৃতপক্ষেই বিস্ময়কর। দর্শকেরা তাঁর কার্টুন নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন, তবে এই প্রদর্শনীতে একত্রে এত কার্টুন দেখার সুযোগ বিরল।
শিল্পী রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন কমিটির এই আয়োজনে প্রদর্শনীর উদ্বোধনের পরে শিল্পী রফিকুন নবী প্রধান অতিথি উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল ও অন্যান্য অতিথিকে নিয়ে জন্মদিনের কেক কাটেন। এরপর চারুকলার বকুলতলার মঞ্চে শুরু হয় জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান। উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য যে রফিকুন নবীর মতো একজন বহুমাত্রিক সৃজনশীল মানুষের ৮০তম জন্মদিন উদ্যাপন করতে পারছি। তিনি তাঁর অনন্য প্রতিভায় সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। সমকালকে জয় করে কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন।’ শিল্পীর শতায়ু কামনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা যেন আরও বর্ণাঢ্য আয়োজনে তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করতে পারি।’
সুদৃশ্য অলংকরণে সজ্জিত ৮০তম জন্মজয়ন্তীর মঞ্চে শিল্পী রফিকুন নবীর সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গী নাজমা বেগম, জন্মজয়ন্তী উদ্যাপন কমিটির সভাপতি আসাদুজ্জামান নূরসহ বিশিষ্ট আলোচকেরা। শিল্পীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য দেন।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁর বক্তব্যে বলেন, স্কুলজীবন থেকেই তিনি রনবীর কার্টুনের ভক্ত। কার্টুনের মাধ্যমেই পরিচয়। তিনি সমাজের তৃণমূল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তাঁর শিল্পকর্মে তুলে ধরেছেন। এমন একজন গুণী মানুষের জন্মদিনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়।
নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, বয়স যা–ই হোক, রফিকুন নবী তাঁর কাজে ও মনেপ্রাণে এখনো তরুণ। কেবল নিজের জন্য নয়, তিনি দেশ ও জনগণের কল্যাণে শিল্পকর্ম করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের মতো যেসব দেশে সহিষ্ণুতার অভাব আছে, সেখানে কার্টুন চর্চা করা কঠিন। রফিকুন নবী সেই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নিজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে কার্টুনচর্চার পথ তৈরি করেছেন।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যেমন তাঁর দুর্ভিক্ষের চিত্রকলা দিয়ে ভারতবর্ষের শিল্পে নতুন ধারা যুক্ত করেছিলেন, তেমনি তাঁর সুযোগ্য ছাত্র রফিকুন নবী টোকাই চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমাদের শিল্পে আরেকটি বাস্তবতার ধারা সৃষ্টি করেছেন।’
রফিকুন নবীকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন আরেক ইমেরিটাস অধ্যাপক শিল্পী হাশেম খান। তিনি বলেন, তাঁরা প্রায় একসঙ্গেই শিল্পকলার শিক্ষা ও শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে তাঁরা ছবি আঁকার পাশাপাশি সব রাজনৈতিক আন্দোলনে নানাভাবে অংশ নিয়েছেন।
ইমেরিটাস অধ্যাপক আতিউর রহমান বলেন, ‘রফিকুন নবী আমাদের দেশের গর্ব। শিল্পসাধনার ভেতর দিয়ে তিনি সমাজের বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা তুলে ধরে আমাদের সচেতন করেছেন। ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করেছেন।’
‘আশিতে আসিয়াছি’ বলে শিল্পী রফিকুন নবী তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে উজ্জীবিত রাখার জন্য এত আয়োজন। যাঁরা এসবের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।’ বাবা রশিদুন নবীর অনুপ্রেরণা ও শিক্ষক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ সব শিক্ষকের কথা তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘পেছনে তাকালে মনে হয় যেন এক মহাসমুদ্র পেরিয়ে এলাম। আমাদের দেশে জীবন অন্য সব দেশের মতো খুব সহজ– সরল পথে এগোয়নি। আমাদের অনেক সংগ্রাম উত্থান–পতনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। সমাজ, রাজনীতি, জীবনের প্রয়োজনে নানা কাজে যুক্ত হতে হয়েছে। এভাবেই কার্টুন, পোস্টার, প্রচ্ছদ এমন একেকটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। শিল্প সৃষ্টির পাশাপাশি তা গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার কাজটিও আমাদের করতে হয়েছে।’ রফিকুন নবী বলেন, ‘এত দিনের এসব কাজের ধারা মেনেই জীবনের বাকি দিনগুলোতে সক্রিয় থাকতে চাই।’
সভাপতির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, রফিকুন নবী তাঁর কাজের ভেতর দিয়ে এ দেশে গণ-আন্দোলন, জনজীবনের আশা ও বঞ্চনাকে ধারণ করেছেন। ৮০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এই কার্টুন ও অন্যান্য কাজের প্রদর্শনী, ছাড়াও জাতীয় জাদুঘর ও গ্যালারি চিত্রকে তাঁর আনুপূর্বিক কাজের প্রদর্শনী চলছে। রাজধানীবাসী তাঁর এই অসামান্য শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ পেলেও সারা দেশের মানুষ এই সুযোগ পেলেন না, আয়োজক হিসেবে এই দুঃখ থাকবে। তিনি শিল্পীর কর্মময় দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
অনুষ্ঠানে প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগতভাবে অনুরাগীরা শিল্পীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। চারুকলা অনুষদ থেকে ‘ঊনসত্তুরে ছড়া’ নামে প্রকাশিত বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, এই ছড়ার বইটি সেই গণ-আন্দোলনের সময় মূলত শিল্পী রফিকুন নবীর উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়েছিল, এর অলংকরণও করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া এই অনুষ্ঠানে রফিকুন নবীর সম্পাদিত তাঁর বাবাকে নিয়ে ‘রশিদুন নবী: শিল্পেই যার আনন্দ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। জার্নিম্যান প্রকাশনী থেকে মঙ্গলবারই শিল্পীর জন্মদিনে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক কবি তারিক সুজাত বইটি শিল্পীর হাতে তুলে দেন।
আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রজ্ঞা লাবণী, শিমুল মুস্তাফা ও জাহিদ মুস্তাফা। এই পর্বের পরে ছিল চা ও শীতের পিঠাপুলির আয়োজন। তারপরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে সংগীত পরিবেশন করেন ছায়ানট, উদীচী, পঞ্চভাস্কর, কারক ও জলের গানের শিল্পীরা। সমবেত নৃত্য পরিবেশন করেন শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা। নাটক মঞ্চায়ন করে আরণ্যক নাট্যদল।
রফিকুন নবীর কাজ নিয়ে জয়নুল গ্যালারি ও গ্যালারি চিত্রকের প্রদর্শনী আগামী ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। আর জাতীয় জাদুঘরের প্রদর্শনী শেষ হবে ৩০ নভেম্বর। প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত।