হাসিন আরমান, কুবি প্রতিনিধি ।।
কথায় আছে, একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না। আর সেই কান্না নেমে এসেছে ইরফানের জীবনে। শুধু কি ইরফানই কাঁদছে? না সাথে পুরো পরিবার কাঁদছে মাত্র একটি দুর্ঘটনায় কারণে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী ইরফান উল্লাহ। তারঁ বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার লনুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গটিয়া ডেঙ্গা গ্রামে। গত বছরের ৯ নভেম্বর একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় বদলে যায় তার জীবন।
অন্যান্য দিনের মতো ঐদিনো টিউশন করিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন ইরফান। কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তিশা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের চাপায় মারাত্মক ভাবে আহত হন তিনি। শরীরের বিশেষ করে হাত, বুক ও মাথায় বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হন। প্রথমে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং সর্বশেষ কল্যাণপুর ইবনে সিনায় স্থানান্তর করা হয়। পনেরো দিনের অন্তর অন্তর বড় দুটি অপারেশন করতে হয়। যাতে ব্যয় হয় কয়েক লাখ টাকা।
তবে, ইরফানের জীবনের গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো না? যদি দুর্ঘটনাটি না হত! ইরফানের নিয়মিত ক্লাসে আসা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলা কিংবা বাবা-মায়ের মুখে হাসির কারণ হতো। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সে আজ ছয় মাস বিছানায় শুয়ে আছে। এখনো অজানা আর কতদিন জিন্দা লাশ হয়ে থাকবে। সকলের কাছ থেকে সে আজ বিচ্ছিন্ন। যাদের সাথে নিয়মিত উঠা-বসা, তাদের থেকে আজ বহু দূরত্ব।
এই দুর্ঘটনা কি শুধু ইরফানের জীবনকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে? না। ভাবুনতো তার পরিবারের অবস্থা! তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মুখ মলিন। এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই বিষয় তা হলো ইরফানের চিকিৎসার খরচ বহন করা সামর্থ্য। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে লক্ষ লক্ষ ব্যয় করার সামর্থ্য যে নেই তা দৃঢ় সত্য। আজ ইরফানের পরিবারের অবস্থা খুবই করুণ।
ইরফানের বড়ভাই আজাদুল্লাহ বলেন, ‘ ইরফান আগের মতোই আছে। বাসায় নিয়ে আসছি। তিনমাস তিনদিন আইসিইউতে ছিল। আইসিইউর বিল এখনও পরিশোধ করা হয় নাই। আনুমানিক খরচ আইসিইউ ছাড়া ৬০ লক্ষ এবং আইসিউ বিল ৩২ লক্ষ টাকা। এখন পর্যন্ত মোট ৬ টা অপারেশন করা হয়েছে। ব্রেইন সার্জারি, হাত যেটা ফ্যাকচার। তিনি আরও বলেন, চিকিৎসার জন্য অনেক সাহায্য পাইতেছি। আমার বিকাশ নাম্বার দিছি, একাউন্ট নাম্বার দিছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিনিয়ররা জুনিয়ররা যে যেভাবে পারছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৫০ হাজার টাকা দিছে পরে আর যোগাযোগ করেনি। ওর ফ্যাকাল্টি থেকে দিয়েছে, ব্যাচমেটরা টিচাররা দিয়েছে।
ছাত্র পরামর্শক ও নির্দেশনা দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একবার অর্থ সহযোগিতা দিয়েছিল। পরবর্তীতে আরও টাকা লাগবে মর্মে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমাকে অবগত করেছিল। তখন তাদের বলেছিলাম প্রত্যেক ডিপার্টমেন্ট এ নোটিশ দাও, টাকা উত্তোলনের একটা ব্যবস্থা করতে হবে আর প্রশাসনকেও আমি বলবো। তার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। এখন তো আর কিছু করতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় খুলুক। আমি তো আবারো ছাত্র পরামর্শক হয়েছি। সামনে আবার একটা ব্যবস্থা করবো। প্রশাসন বরাবর চিঠি লেখব, প্রতি ডিপার্টমেন্ট থেকে টাকা উঠাবো। একটু সময়ের ব্যাপার কিন্তু উদ্যোগটা নেয়া যেতে পারে।’
ইরফানের চিকিৎসা ব্যয় বহনের জন্য প্রজেক্ট ‘ইরফানের জীবন’ এর মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গা টাকা সংগ্রহ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখান ঠীক শিক্ষার্থীরা প্রায় চার লাখ টাকা ইরফানের পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রজেক্ট ‘ইরফানের জীবন’ এর সাথে যুক্ত নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহসীন জামিল বলেন , ‘ আমরা স্ট্রিট লেভেলে যখন কাজ করি তখন ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। ইদুল ফিতর এর পর একসাথে সাড়ে তিন লাখ এবং এরপর আরেকবার ত্রিশ হাজার, সর্বমোট প্রায় চার লক্ষ টাকা দিতে পেরেছি। আর বর্তমানে কালেকশন হচ্ছে না কিন্তু বিকাশে বা অন্য কোনো মাধ্যমে কেউ টাকা পাঠালে আমরা সেটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমাদের মূল টার্গেট ছিল স্ট্রিট লেভেলে কাজ করা। যদি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকতো আমরা শিক্ষার্থীরা সবাই কাজ করতে পারতাম। এই সুযোগটাও হচ্ছে না। যদি আবারও প্রয়োজন হয় আমরা আবারও কাজ করবো।’
পরিবার, শিক্ষক, বন্ধু, বড়ভাই সকলের চাওয়া ইফতার আবার ফিরে আসুক আগের মত করে সবার মাঝে। তবে তার জন্য দরকার অর্থের। কারণ, সে এখনো সুস্থ হয়ে উঠেনি।