স্টাফ রিপোর্টার ।।
দেশে চলমান অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে দেশের প্রধান চারটি রাজনৈতিক দল—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার জানিয়েছে। একইসঙ্গে তারা দেশে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য গঠনের ঘোষণাও দিয়েছে।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) রাত ৯টায় রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক জরুরি বৈঠকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন চার দলের শীর্ষ নেতারা। বৈঠক চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের সামনে বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু তুলে ধরেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক নেতারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান—দেশে পরিকল্পিতভাবে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো হচ্ছে, যা প্রতিহত করতে প্রশাসনকে আরও কঠোর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। নেতারা বলেন, বারবার সচিবালয় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় পরিষ্কার হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রে কোথাও না কোথাও দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। তারা এসব দুর্বলতা চিহ্নিত করে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বৈঠকে নেতারা বিশেষভাবে আলোচনায় আনেন আগের দিন (২১ জুলাই) রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ২০ শিক্ষার্থী নিহত এবং শতাধিক শিক্ষার্থী দগ্ধ হওয়ার ভয়াবহ দুর্ঘটনাকে। জামায়াত নেতা তাহের বলেন, “এই ঘটনায় জাতির হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং দগ্ধদের পূর্ণ চিকিৎসার দাবি জানানো হয়েছে।” এ বিষয়ে রাষ্ট্র ও সরকারকে আরও মানবিক, দায়িত্বশীল এবং সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
বৈঠকে নেতারা একমত হন যে, দেশে নতুন একধরনের ‘ফ্যাসিবাদী রাজনীতি’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যা রাজনৈতিক পরিবেশকে ঘোলাটে করতে চায়। সেই লক্ষ্যে তারা ঘোষণা দেন: “যেখানে ফ্যাসিবাদ, সেখানেই প্রতিরোধ।” রাজনৈতিক মতানৈক্য থাকলেও ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রশ্নে সবাই একমত—এমনটিই জানানো হয় প্রধান উপদেষ্টাকে।

চারটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর সেখানে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে বলেননি শুধু ঐক্য গড়ার কথা, বরং তিনি বলেছেন এই ঐক্য যেন দৃশ্যমান হয়। জনগণকে দেখাতে হবে যে তারা একত্রে কাজ করছে, যাতে মানুষের মধ্যে স্বস্তির বোধ তৈরি হয়।”
বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠকে তুলে ধরা হয় একটি সুসংবদ্ধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা। তারা বলেন, “নির্বাচন ঘিরে যেকোনো বিশৃঙ্খলা রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী করতে হবে।” নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করতেই তারা অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান দলটির নেতারা।
এই ঐতিহাসিক বৈঠকে অংশ নেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী; জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ; জাতীয় নাগরিক পার্টি–এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন; ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন এবং যুগ্ম-মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান।

যমুনায় বৈঠক চলাকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চার দলের নেতারা
বৈঠকে সকল নেতাই ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের প্রতি সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউ’—এই কথা উদ্ধৃত করে জামায়াত নেতা তাহের বলেন, “আগাম প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির মাধ্যমেই জাতীয় দুর্যোগ ও সন্ত্রাস মোকাবিলা সম্ভব।” তিনি আরও বলেন, “আমরা সরকারের পাশে আছি এবং থাকব ইনশাআল্লাহ।”
অন্যদিকে এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের নেতারাও জানান, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে জাতীয় স্বার্থে একযোগে কাজ করবেন।
সরকার ও বিরোধী রাজনীতির মাঝে এই সদিচ্ছা, সংলাপ ও সহযোগিতার নতুন ধারা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশবাসী আশা করছে, এই ঐক্য ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে একটি স্থায়ী শক্তিতে রূপ নেবে এবং দেশে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক শাসনের পথ সুগম করবে।