প্রোফাইল ডেস্ক ।।
এবনে গোলাম সামাদ (Abney Golam Samad) একজন ত্রিকালদর্শী শিক্ষাবিদ, নৃতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, লেখক, সাহিত্য-সমালোচক এবং রাজনীতি বিশ্লেষক। ১৯২৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশরাজ থেকে পাকিস্তান আমল হয়ে তিনি দেখেছেন ঠিক ৫০ বছর বয়সী এক পরিণত বাংলাদেশের চিত্র আর সে দেখাকেই করেছেন তার লেখার সবচেয়ে বড় উপজীব্য। বগুড়া থেকে তার পিতা মো: ইয়াসিন আলী রাজশাহী রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার হিসেবে যোগদান করেন। তার মাতার নাম নছিরন নেসা। জানা যায়, তার পিতাও একজন সুসাহিত্যিক ছিলেন। তার এক বোনের নাম দৌলতুন্নেসা খাতুন যাকে নিয়ে এখনো বেশ আলোচনা হয়। দৌলতুন্নেসা ছিলেন একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, লেখিকা এবং অধিকারকর্মী। ১৯৫৪ সালে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাদৈশিক পরিষদের নির্বাচিত এমএলএ ছিলেন। এর পূর্বে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘লবণ আইন’ পাস করলে দৌলতুন্নেসা মহাত্মা গান্ধী ঘোষিত ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ এর (লবণ সত্যাগ্রহ) সভায় ও মিছিলে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে গ্রেফতার হয়েছিলেন। এবনে গোলাম সামাদ বলতেন, মূলত তার বোনের নির্বাচনী জনসভাগুলোতেই তিনি এপারের বড় বড় রাজনীতিবিদদের খুব কাছ থেকে দেখতে পেরেছিলেন; যেমন একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমানসহ অনেককে। ট্রেনে সফর করেই সেই নেতাদের সাথে তিনি বোনের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতেন।
এবনে গোলাম সামাদ ১৯৪৮-এ তিনি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা সঙ্ঘ বিষ্ণুপুর স্কুল-কোর্স পাস করেন, যা তখনকার মাধ্যমিক সমমানের। এরপর তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তেজগাঁও কৃষি ইনস্টিটিউট (যা বর্তমান শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে কৃষিবিদ্যায় স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি বিলেতের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের ওপরে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা করতে। পরবর্তীতে ফ্রান্সের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় পুয়েতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্ল্যান্ট ভাইরাসের ওপরে চার বছর গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে ফরাসি ভাষায় তার পিএচডি অভিসন্দর্ভটি প্রকাশিত হয়। এর মাঝে কিছুদিন তিনি বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটে চাকরি করেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে তিনি ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কাছ থেকে প্রত্যক্ষ্ করেন ১৯৬৯ সালের আইয়ূব-বিরোধী আন্দোলনে তারই সহকর্মী ড. জোহার শহীদ হওয়ার ঘটনাটি। স্বাধীনতার দাবিতে রাজশাহীতে পতাকা মিছিল হলে প্রথম সারিতে অংশ নেন তিনি। তারপর ১৯৭১ সালে তিনি পদ্মানদী পাড়ি দিয়ে কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা পত্রিকা’ এর সাথে যুক্ত হন। সেখানে তিনি সংবাদ-লেখক হিসেবে কাজ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, আসাদ চৌধুরীসহ অনেকের সাথে। তবে তিনি নিয়মিত কাজের বাইরে তার অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন পুরো পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে তিনি দেখা পান প্রখ্যাত সাহিত্যিক জহির রায়হান, আহমদ ছফাসহ অনেকের। নিজ ভাই’র বাড়িতে জহির রায়হানকে থাকার ব্যবস্থা করে দেন ড. সামাদ। তাছাড়া জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তিনি ছিলেন সবসময়ই সোচ্চার, লিখেছেন একাধিক কলাম। মওলানা ভাসানীর সাথে হেটেছেন ১৯৭৬ সালে ফারাক্কা অভিমূখের সেই বিখ্যাত লংমার্চে। ৬০ এর দশকে একাধিক ঘরোয়া বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার হয়েছে আলাপ।
১৯৯৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসরে গেলেও লেখালিখিকে কখনো অবসর দেননি ড. সামাদ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার পাঠকদের তৃষ্ণা মেটানোর কাজ করে গেছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন প্লাটফর্মে নানাসময়ে বক্তৃতা-প্রবন্ধ পাঠ করেছেন। লেখালিখির ক্ষেত্রে তার বিরাট বৈচিত্র্য নিয়ে তিনি নিজে বলেন, দু-তিনটি বিষয়ের বাইরে বাকিগুলোতে একজন সাধারণ চিকিৎসকের মত পথ্য লেখতে পারেন, কিন্তু বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসা দিতে তিনি পারেন না। এছাড়া লেখালিখির এই শিল্পকে তিনি একজন রাজমিস্ত্রির কাজের সাথে তুলনা করে বলতেন, তিনি প্রয়োজনীয় মাল-সামাল পেলে কেবল সুন্দর আকৃতি গড়তে জানতেন। নতুন সৃষ্টি অতটা করতে পারতেন না।
সিকান্দার আবু জাফরের বিখ্যাত পত্রিকা সমকালে তিনি অসংখ্য লেখা লিখেছেন, তর্কে জড়িয়েছেন। এর বাইরে অজস্র দৈনিকে তিনি আমৃত্যু লিখেছেন। মতামত পেশ করেছেন অসংখ্য সম্পাদিত বইয়ে। বিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান এবং শিল্পকলা বিষয়ে একাধিক আকর-গ্রন্থ সহ তিনি বিশের অধিক কিতাব লিখেছেন।
২০২১ সালের ১৫ আগষ্ট এই পন্ডিতমনীষী দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার চিরচেনা রাজশাহীর নছিরন ভিলাতেই ছিলেন। শেষ বিদায়ের আগে হৃদযন্ত্রের সমস্যাসহ মহামারী করোনার আঘাতে তিনি শারীরিকভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন।