স্টাফ রিপোর্টার ।।
বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের প্রতিভা অন্বেষণের জন্য জাতীয় পর্যায়ের প্রথম রিয়েলিটি শো হিসেবে খ্যাত ‘নতুন কুঁড়ি’ দীর্ঘ ১৯ বছর পর আবারও পর্দায় ফিরছে। বিটিভির উদ্যোগে ১৯৭৬ সালে মুস্তফা মনোয়ারের প্রযোজনায় যাত্রা শুরু করা এই জনপ্রিয় আয়োজন গান, নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি, গল্পবলা ও অন্যান্য শিল্পকলার মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তরুণ শিল্পী খুঁজে বের করেছে। অনুষ্ঠানটির মঞ্চ থেকে উঠে এসে বহু শিল্পী দেশের সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতে উজ্জ্বল সাফল্য অর্জন করেছেন।
শুরু থেকে জনপ্রিয়তা
প্রথমবার ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান টেলিভিশনে স্বল্প পরিসরে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল নতুন কুঁড়ি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে জাতীয় টেলিভিশন প্রতিযোগিতা হিসেবে পুনরায় শুরু হয় এটি। অনুষ্ঠানের নাম রাখা হয়েছিল কবি গোলাম মোস্তফার কিশোর কবিতা থেকে, যার প্রথম পনেরো লাইন ছিল অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী থিমসং। মোস্তফা মনোয়ারের নির্দেশনায় শুরু হওয়া নতুন কুঁড়ি দ্রুতই শিশু-কিশোরদের প্রতিভা বিকাশের অন্যতম মঞ্চে পরিণত হয়।
তারকাদের সূচনা মঞ্চ
এই আয়োজনে অংশ নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন তারানা হালিম, রুমানা রশিদ ঈশিতা, তারিন জাহান, মেহের আফরোজ শাওন, নুসরাত ইমরোজ তিশা, জাকিয়া বারী মম, তমালিকা কর্মকার, সাবরিন সাকা মীম, আজাদ রহমান শাকিল, সামিনা চৌধুরী, হেমন্তী রক্ষিত দাস, মহবুবা মাহনুর চাঁদনীসহ আরও অনেকে। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, নাট্যাঙ্গন ও সঙ্গীতজগতে এসব শিল্পীরা রেখে গেছেন স্থায়ী ছাপ।
বন্ধ হয়ে যাওয়া ও দীর্ঘ বিরতি
২০০৬ সালের পর অলিখিত কারণে অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বিটিভির আর্থিক সংকট, বেসরকারি চ্যানেলের উত্থান এবং গণমাধ্যমের পরিবর্তিত পরিস্থিতি এ সিদ্ধান্তের পেছনে প্রভাব ফেলেছিল। ২০২০ সালে পুনরায় শুরু করার পরিকল্পনা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে তা সম্ভব হয়নি।
ফেরার ঘোষণা ও আবেদন প্রক্রিয়া
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিটিভির নিজস্ব পেজে ‘নতুন কুঁড়ি’ ফেরার ঘোষণা দেওয়া হয়। আগামী ১৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিযোগিতার জন্য আবেদন গ্রহণ করা হবে, যার বিস্তারিত নিয়মাবলি পাওয়া যাবে বিটিভির ওয়েবসাইটে।
পর্যায়ভিত্তিক বাছাই
বিটিভির মহাপরিচালক মাহবুবুল আলম জানান, পুরো দেশকে ১৯টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রাথমিক বাছাই অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিটি অঞ্চলের শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে প্রাথমিক বাছাই হবে, সেখান থেকে নির্বাচিতরা যাবে বিভাগীয় বাছাই পর্বে। চূড়ান্ত বাছাই ও ফাইনাল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায় ২ থেকে ৬ নভেম্বরের মধ্যে।
১৯টি অঞ্চল
প্রাথমিক বাছাই পর্বের অঞ্চলগুলো হলো—ঢাকা-১ (ঢাকা, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ), ঢাকা-২ (মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী), ঢাকা-৩ (ফরিদপুর, রাজবাড়ি, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর), ময়মনসিংহ-১ (ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোণা), ময়মনসিংহ-২ (টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও জামালপুর), সিলেট (সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ), রংপুর-১ (রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা), রংপুর-২ (দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়), রাজশাহী-১ (রাজশাহী, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ ও পাবনা), রাজশাহী-২ (বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও সিরাজগঞ্জ), খুলনা-১ (খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা), খুলনা-২ (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল), খুলনা-৩ (কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা), বরিশাল-১ (বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর), বরিশাল-২ (পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা), চট্টগ্রাম-১ (চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার), চট্টগ্রাম-২ (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি), চট্টগ্রাম-৩ (কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া) এবং চট্টগ্রাম-৪ (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী)।
প্রতিযোগিতার বিষয় ও বয়সসীমা
অভিনয়, আবৃত্তি, গল্পবলা/কৌতুক, সাধারণ নৃত্য/উচ্চাঙ্গ নৃত্য, দেশাত্মবোধক গান/আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, লোকসংগীত ও হামদ-নাত—এই ৯টি বিষয়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। ‘ক’ শাখায় ৬–১১ বছর বয়সী এবং ‘খ’ শাখায় ১১–১৫ বছর বয়সী ছেলে-মেয়ে অংশ নিতে পারবে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক
‘নতুন কুঁড়ি’ শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং বহু মানুষের জন্য আজীবনের শিল্পযাত্রার প্রথম ধাপ। এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রতীক হিসেবে এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। দীর্ঘ বিরতির পর ফেরার ঘোষণায় দর্শকদের মধ্যে নস্টালজিয়া ও আনন্দের স্রোত বইছে।