সৈয়দ হাসসান ।।
একুশে ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে ২০২৫ সালের একুশে পদকের জন্য মনোনীতদের প্রাথমিক তালিকার তথ্য জানা গেছে। এ তালিকায় সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নাম রয়েছে। তার সাংবাদিকতা ও প্রকাশনার নির্ভীক ভূমিকা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় অবদান এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে লেখনী তাকে এ সম্মাননার জন্য প্রস্তাবিত করেছে— জানিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ১৯৭৬ সালে তাৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রবর্তিত এই পদক দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা। প্রতি বছর ভাষা আন্দোলন, সাহিত্য, শিল্পকলা, সাংবাদিকতা, গবেষণা, শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য একুশে পদক দেওয়া হয়। এবার প্রাথমিকভাবে ২৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান মনোনীত হয়েছে।
২০২৫ সালের একুশে পদকের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
ভাষা আন্দোলনে অবদান:
আবু জায়েদ শিকদার (মরণোত্তর), বেগম মাজেদা বেগম, বদিউল আলম চৌধুরী (মরণোত্তর)।
শিল্পকলায় অবদান:
লুবনা মরিয়ম (নৃত্যে), আজিজুর রহমান (মরণোত্তর, চলচ্চিত্রে), ড. নাশিদ কামাল (সংগীতে), শহীদ মাহমুদ জঙ্গী (সংগীতে), বেবী নাজনীন (সংগীতে), উস্তাদ নীরদ বরণ বড়ুয়া (মরণোত্তর, সংগীতে), সাইদুর রহমান বয়াতি (সংগীতে), সুনীল চন্দ্র দাস (যন্ত্রসংগীতে), নাসির আলী মামুন (আলোকচিত্রে), রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা (চিত্রকলায়), অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সাত্তার (চারুকলায়)।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান:
এ বি এম নুরুদ্দীন (কাপ্তান নূর)।
সাংবাদিকতা:
মাহফুজউল্লাহ (মরণোত্তর), মাহমুদুর রহমান (আমার দেশ সম্পাদক)।
গবেষণা:
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকা বিভাগ, ড. এসএম মফিজুল ইসলাম।
শিক্ষা:
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, ড. মঞ্জুর করিম পিয়াস (মরণোত্তর)।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি:
মেহেদী হাসান খান।
অর্থনীতি:
মুহাম্মদ আনিসুর রহমান (আনু মুহাম্মদ)।
সমাজসেবা:
মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী (মরণোত্তর)।
ভাষা ও সাহিত্য:
ড. নিয়াজ জামান, কবি হেলাল হাফিজ (মরণোত্তর), শহীদুল জহির (মরণোত্তর)।
এক নজরে মাহমুদুর রহমান
মাহমুদুর রহমান একজন বাংলাদেশি প্রকৌশলী, সাংবাদিক ও উদ্যোক্তা। বর্তমানে তিনি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নির্ভীক সাংবাদিকতা ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনার জন্য তিনি বারবার বিতর্ক ও ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছেন। বিশেষত, আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করায় তাকে নানাভাবে হয়রানি এবং আইনি জটিলতায় ফেলা হয়েছে।
মাহমুদুর রহমান ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর জাপানে কর্মরত অবস্থায় ১৯৮৬ সালে সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন।
তার কর্মজীবন শুরু হয় ব্রিটিশ অক্সিজেন কোম্পানিতে অপারেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। এরপর তিনি মুন্নু সিরামিক, ডাকান ব্রাদার্স, বেক্সিমকো গ্রুপ, এবং পদ্মা টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কাজ করেন। ১৯৯৮ সালে দেশে ফিরে তিনি নিজ উদ্যোগে আর্টিসান সিরামিক লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন, যা দেশে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
২০০১ সালে বিএনপি সরকারের আমলে মাহমুদুর রহমান জাতীয় বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে “পাঁচ আই থিওরি” (Five I’s Theory) বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়ে। তার সময়কালে ২০০২ থেকে ২০০৩ সালে বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগ ৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। ২০০৪ সালে এটি আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৪৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়, যা দক্ষিণ এশিয়ায় তখনকার মধ্যে সর্বোচ্চ।

রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমান। ফাইল ফটো
২০০৮ সাল থেকে মাহমুদুর রহমান আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। পত্রিকাটি সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় বারবার বিতর্কে জড়িয়েছে। তার নেতৃত্বে পত্রিকাটি সাহসিকতার সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে এসব কর্মকাণ্ড তাকে সরকারের প্রতিহিংসার শিকার করেছে।
২০১৩ সালে তাকে আমার দেশ পত্রিকার কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, ব্লগারদের লেখা ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও মানহানির ৫০টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যাকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি দিয়েছিল।
দীর্ঘ কর্মময় জীবনে মাহমুদুর রহমান একাধিকবার গ্রেফতার, মামলা ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার উদ্যোগী মনোভাব, নির্ভীক সাংবাদিকতা এবং দেশের জন্য অবদান তাকে একটি বিশেষ স্থান দিয়েছে।
মাহমুদুর রহমানের জীবন কেবল একজন পেশাজীবী বা সাংবাদিকের নয়, বরং একজন সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি, যিনি স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করে চলেছেন।