খালেদ সাইফুল্লাহ ।।
সংখ্যালঘু টার্মটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগাগোড়াই একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষভাবে বললে, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির বিকাশ ও ফ্যাসিবাদি ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের সাথে ‘সংখ্যালঘু’ রাজনীতির ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে এই ধারার ধারক ও বাহক হিসেবে আওয়ামী লীগই মূলত ক্ষমতায় যাওয়ার সিড়ি হিসেবে সংখ্যালঘুদেরকে গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে বারবার। আর তা সম্ভব হয়েছে ৪৭ নিয়ে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী ধারার লেখক-বুদ্ধিজীবিদের একধরণের হীনমন্য অবস্থানের কারণে, যারা ৪৭ এর দেশভাগকে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
এই বয়ানের উপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগ বিরোধী বাকি রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দীর্ঘদিন যাবত সংখ্যালঘু বিরোধী তকমা দেওয়ার একটি অপচেষ্টা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে বিদ্যমান আছে। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এর মাধ্যমে দেশটির সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের রাজনৈতিক ও কৌশলগত সমর্থন পেয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। গত ৫ আগস্ট গনঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী শক্তি আওয়ামী লীগের পতনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদেরকে সহায়তা করে এসেছে আওয়ামী লীগ।
৫ আগস্ট বাংলাদেশে সরকার পতনের পর থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সংখ্যালঘু ইস্যুটিকে মোকাবেলা করা। কারণ, এর অব্যবহিত পর থেকেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো সংখ্যালঘু নির্যতন নিয়ে একচেটিয়া সংবাদ প্রকাশ করে গেছে। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা পেইজগুলোর ছড়ানো ভূঁয়া ছবি, ভিডিও এবং লেখার ভিত্তিতে তারা সংবাদ প্রচার করতে থাকে। এর মধ্যেই সীমান্ত সংলগ্ন কিছু এলাকার অনেকেই সম্ভাব্য আক্রমনের শঙ্কায় কিংবা অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ ছাড়তে সীমান্তে জড়ো হয়।
তবে বাস্তবে এমন আক্রমণের কোনো খবর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম জানাতে পারেনি। সংখ্যালঘুদের উপর যেসব আক্রমনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো ছিলো রাজনৈতিক। পতিত স্বৈরাচারের পক্ষে বিভিন্ন দমনমূলক কার্যক্রমে অংশ নেওয়ায় ৫ আগস্টের পর থেকে বিক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর প্রতিশোধপরায়ন হয়েছে। একইভাবে রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীও জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়েছে।
৮ আগস্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু নিপীড়নের প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের বিচার ও দুর্গাপূজার ছুটি বৃদ্ধিসহ ৮ দফা দাবিতে সারাদেশ থেকে লংমার্চ করে তারা শাহবাগে জড়ো হয়। এরই মধ্যে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি সেখানে তাদেরকে সংখ্যালঘু হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবে, দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে সাংবিধানিক অধিকার চাওয়ার আহ্বান জানান। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বিভিন্ন হামলার ঘটনায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। পরবর্তীতে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সাথে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন এবং নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণের আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত করার ঘোষণা দেন।
সম্প্রতি সনাতন জাগরণ মঞ্চ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে আট দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম নগরের লালদীঘি মাঠে গণসমাবেশ করেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এ সংগঠনের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী দাবি করেছেন, সনাতনীদের এ দেশ থেকে উৎখাতের চেষ্টা করা হচ্ছে। বেছে বেছে হিন্দুদের নামে মামলা ও তাদেরকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই নেতা। এছাড়াও সারাদেশ থেকে হিন্দুদের ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
দূর্গাপুজার ছুটি বৃদ্ধির দাবিটি দীর্ঘদিনের হলেও অন্তর্বর্তী সরকারই প্রথমবারের মত ছুটি বাড়িয়ে ৩ দিন করেছে। বাকি দাবিগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমের মধ্যেই বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। তবে ৮ আগস্ট থেকে সরকার যখন রাষ্ট্র পুনর্গঠনে ব্যস্ত, ঠিক সেসময়েই আট দফা নিয়ে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে হিন্দু জাগরণ মঞ্চসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন সংগঠন। ইতোপূর্বে ২০১৮ সাল থেকে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনায় ৩০৭টি মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৭টি মামলার বিচার হয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মতে, ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় দেশের ২৭টি জেলায় ১১৭টি মন্দির-পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করা হয়। ৩০১টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়ি হামলা-লুটপাটের শিকার হয়। তবে এসব ব্যাপারে তখন সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন সংগঠনকে আওয়ামী লীগের উপর আস্থাশীল থাকতে ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোকেই দোষারোপ করতে দেখা গেছে।
তবে বর্তমানে সংখ্যালঘুদের এসব সংগঠন চাইলে সরকারের উপর আস্থা রেখে শান্তিপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। অথচ এর পরিবর্তে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। আন্দোলনের পালে হাওয়া দিচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। সেখানকার বিখ্যাত সব সংবাদমাধ্যমগুলো একের পর এক অসত্য ও মুখরোচক তথ্যের মাধ্যমে সংখ্যালঘু নিপীড়নের খবর পরিবেশন করছে। এব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়ে আগস্ট মাসে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংখ্যালঘু নিপীড়নের সংবাদগুলোর সত্যতা খুজে পায়নি বিবিসি। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আক্রান্ত অধিকাংশ স্থাপনাগুলোই ছিলো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের মালিকানায়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর পাশাপাশি সেখানকার রাজনীতিবিদেরাও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন। ৫ আগস্টের পর থেকেই ক্ষমতাসীন বিজেপি ও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্রমাগত এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে, আপাতদৃষ্টিতে যা তাদের অতিউৎসাহের বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনার পতনের অব্যবহিত পরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক ভাষণে বলেন, ১৪০ কোটি ভারতীয় বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ড. ইউনুসের শপথ গ্রহণের পর তাকে পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তায়ও মোদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভারত একটি কমিটিও গঠন করেছে।
তবে এবছর দূর্গাপুজাকে সামনে রেখে ভারত যেভাবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কার কথা প্রচার করেছে, পরবর্তীতে তেমন কিছুই বাস্তবে ঘটেনি। বরং আগের বছরগুলোর তুলনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আরো বেশি নিরাপত্তার সাথে পুজা উদযাপন করেছে। কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা রোধে সকল দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ কাজ করেছে প্রতিটি এলাকায়। তবে এর মধ্যেও পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের পূজামণ্ডপে হামলা এবং সাতক্ষীরায় যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে চুরির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে এবং এ ঘটনায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিং-এ উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গ্রুপগুলো একের পর এক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে যৌক্তিক, অযৌক্তি উভয় প্রকার দাবিই রয়েছে। তবে ভারতীয় মিডিয়াতে যে গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা চলমান তা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও জনগনকে বিশ্ব দরবারে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা যায়। এসব প্রচারণা সংখ্যালঘুদের প্রকৃত চিত্র আড়াল করে তাদেরকে লাগাতার আন্দোলনে উৎসাহিত করছে।
সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো বিশেষ আইন নয়, বরং বাংলাদেশের সংবিধান দেশের প্রতিটি নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছে। ফলে ড. ইউনুস সংখ্যালঘুদেরকে বিভাজন বৃদ্ধির চাইতে দেশের নাগরিক হিসেবে গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে বলেছেন। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে ভারতীয় মিডিয়াগুলো এই বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ব্যর্থ হিসেবে পরিচিত করাতে চাইছে। বিভাজনমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, বিশেষত সনাতন সম্প্রদায়কে তাদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে হবে।
লেখক : অ্যাক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট