শুক্রবার, জুলাই ১৮, ২০২৫

সশস্ত্র দলগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে —ওয়াদুদ ভূইয়া

by ঢাকাবার্তা
ওয়াদুদ ভূইয়া

ওয়াদুদ ভূইয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে একটি আলোচিত নাম। তিনি খাগড়াছড়ির সাবেক এমপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি সভাপতি। আলোচিত, কোথাও সমালোচিত এ নেতা পার্বত্য চট্টগ্রামের কারো কাছে ত্রাতা, কারো কাছে আতঙ্ক।

স্কুল জীবনে রাজনীতির মাঠে পা রেখেছেন। পাহাড়ি নেতা সন্তু লারমা, সুধাসিন্ধু চাকমা, প্রসিত বিকাশ খীসাসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীগুলোর প্রধান বাধা, পাহাড়-পর্বতের রাজনীতির এই রহস্য পুরুষকে মিডিয়ায় বলা হয় পাহাড়ের গডফাদার। পার্বত্য চট্টগ্রামের জানা-অজানা বিষয় এবং পাহাড়ের রাজনৈতিক নানা দিক নিয়ে সম্প্রতি ওয়াদুদ ভূইয়ার মুখোমুখি হয়েছিলেন এ এইচ এম ফারুক

প্রশ্ন : পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন সময় নানামুখী ষড়যন্ত্রের কথা শোনা যায়। আপনি দীর্ঘদিন পাহাড়ে রাজনীতি করছেন, সংসদ সদস্যও ছিলেন। এই ষড়যন্ত্রগুলো কী ধরনের?

উত্তর : পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূ ও নৃতত্ত্বগত দিক থেকে দেশের অন্য অঞ্চলগুলেঅ থেকে কিছুটা আলাদা। আয়তনে দেশের ১০ ভাগের ১ ভাগ এ অঞ্চলকে ঘিরে অনেক রকম ষড়যন্ত্রই কানে আসে। এর মধ্যে যৌক্তিক কারণেই সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশ থেকে আলাদা করার প্রচেষ্টাটি। বাংলাদেশ যখন পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলো, তখন দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল ভঙ্গুর। এ দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাহাড়কে স্বাধীন বা পৃথক করে ফেলতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জন্ম নিল। উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে সৃষ্ট এ চরমপন্থী আন্দোলনের কারণে অনেক মূল্য চুকাতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তারা চেয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘জুম্মল্যান্ড’ নামের পৃথক একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করতে।

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির (যা শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত) মাধ্যমে ভাবা হয়, এর আপাত সমাধান হয়েছে। যদিও আগের বিএনপি সরকার এজন্য অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। নয়তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার ১ বছরের মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করতে পারতো না। দেশের স্বার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যায়, বিএনপি কিন্তু এমন কিছুতে রাজি হয়নি। বিএনপি সরকারের সাফল্যকে ব্যবহার করে এবং বিএনপি দেশের স্বার্থে যেসব ছাড় দিতে রাজি হয়নি, সেসব ছাড় দিয়ে আওয়ামী লীগ পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করে।

কিন্তু ৯৭ পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে এখন কি পরিস্থিতি কম অগ্নিগর্ভ? মোটেই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে বেশি। শান্তি কিন্তু এখনও আসেনি। এখনও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র আমদানির খবর নিয়মিতই শোনা যায়। বিচ্ছিন্নতাবাদ আন্দোলন নতুন রূপ নিয়েছে। প্রতি বছর বাঙালি-পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে আদায় করা শত-কোটি টাকার বিশাল অংশ ব্যয় হয় অস্ত্র কেনা, বিদেশে লবিং ও প্রচারণার কাজে। দেশের একশ্রেনীর বুদ্ধিজীবী এবং গণমাধ্যমও যে এর ভাগীদার নয় তা-ও বা কে বলতে পারে? সবকিছু বিবেচনা করলে বোঝা যায়, ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র সেটিও পাহাড়কে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। তবে একটু ভিন্ন ধাঁচে। যে কায়দায় ইন্দোনেশিয়া থেকে পুর্ব তিমুর, সুদান থেকে দক্ষিণ সুদান আলাদা করা হয়েছিল। অনেকটা সেই একই কায়দায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে গণভোটের মাধ্যমে পাহাড়কে আলাদা করার ষড়যন্ত্রেরে কথাও শোনা যায়। পাহাড়ের অনেক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, যারা সরকারী সুবিধা কখনই পায়নি, তাদের আর্থিক দুরবস্থাকে ব্যবহার করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে বিভিন্ন মিশনারি ও এনজিও। এক্ষেত্রে তথকথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন বা সিএইচটি কমিশনসহ একাধিক সংস্থা, সংগঠন কাজ করছে। কারণ এদেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত এই কমিশনের নেতৃত্বে রয়েছে বৃটিশ পার্লামেন্ট মেম্বার এরিক এভাব্যুরি। এছাড়াও এই কমিশনে বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে মিখায়েল সি. ভন ওয়াল্ট ভন প্রাগ, লারস অ্যান্ডারস বায়ার, এলসা স্টামাটোপৌলৌ ও হারস্ট হাননুমের নাম উল্লেখযোগ্য। এ চক্রটির বিরুদ্ধে ইতোপূর্বেও বিভিন্ন দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তথা ষড়যন্ত্র সৃষ্টি করে দেশ বিভক্ত করার রেকর্ড আছে।  যেমন সাম্প্রতিক সময়ে সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানকে এবং এর আগে ইন্দোনেশিয়া থেকে পুর্ব তিমুরকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এরা কাজ করেছে। সেই বৃটিশ লর্ড ও পাদ্রিরা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিচ্ছন্নতাবাদীদের সক্রিয়ভাবে দেশে ও বিদেশে সমর্থন দেন। অর্থাৎ, দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।

প্রশ্ন : ৯ আগস্ট ছিল বিশ্ব আদিবাসী দিবস। দেশে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিয়ে আদিবাসী-উপজাতি বিতর্ক চলছে। এর কারণ কী?

উত্তর : এ বিতর্কটা কিছুটা অদ্ভুত। পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহকে ইংরেজিতে ট্রাইবাল বলা হয়। বিশ্বের অনেক জাতিগোষ্ঠিকে ট্রাইবাল বলা হয়। যেমন ভারতে এখনও ট্রাইবাল কথাটিই প্রযোজ্য। এ ট্রাইবাল শব্দটির বাংলা অনুবাদ অনেকে করেছেন উপজাতি। এ নিয়ে তেমন বিরোধ আগে হয়নি। এর প্রমাণ হলো, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কিন্তু পার্বত্য চুক্তিতে নিজেদের উপজাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েই স্বাক্ষর করেছিল। যেমন চুক্তির একটি ধারায় রয়েছে, ‘পার্বত্য জেলা পরিষদের বিভিন্ন ধারায় উপজাতি শব্দটি বলবত থাকিবে।’

আবার ‘পৃথক জাতিসত্ত্বার’ দাবিতে একটি উগ্রতা যখন চারদিকে, তখন উপজাতি শব্দটি শুনে অনেকে ভেবে বসে, এ শব্দটি মনে হয় জাতির উপশাখা বোঝায়। কিন্তু আদতে তা নয়। যদি উপজাতি কথাটি জাতির উপশাখাই বোঝাতো, তাহলে এর ইংরেজি অর্থ হতো ‘সাব-নেশন’, ‘ট্রাইবাল’ নয়। কোনো শব্দের আগে ‘উপ’ উপসর্গটি থাকলেই সেটি মূল জিনিসের শাখা বোঝায় না। যেমন, উপদেশ শব্দটি কিন্তু দেশের উপশাখাকে বোঝায় না। অর্থাৎ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। দেশের অনেক ‘পণ্ডিত’ এ কারণে ট্রাইবালের বদলে পাহাড়িদের ‘অ্যাবরিজিনাল’ নামে ডাকতে শুরু করে। অথচ, অ্যাবরিজিন্স কিন্তু শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ার একটি নৃগোষ্ঠী তথা ট্রাইবাল গোষ্ঠির নাম। আমাদের যেমন, চাকমা, মারমা; তাদেরও তেমনি অ্যাবরিজিন্স। কিন্তু এ শব্দটির অনুবাদ করা হলো ‘আদিবাসী’। অথচ, কারো নামের বা জাতির অনুবাদ করা যায় না। কিন্তু তখন এসব নিয়ে খুব বেশি মানুষ মাথা ঘামায়নি। শুনতে ভালো লাগে বলে এ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে গেল। কিন্তু জাতিসংঘ ঘোষিত ‘ইন্ডিজেনাস’ শব্দটিকেও যখন আদিবাসী বলা হলো, তখনই বিপত্তি বাঁধে।

প্রশ্ন : ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় যদি খুশি হয় তবে আদিবাসী বললে সমস্যা কোথায়?

উত্তর : সমস্যা এখানে তাদের খুশি বা অখুশি নিয়ে নয়। সমস্যা অনেক গভীর ও সুদূরপ্রসারি। কারণ, জাতিসংঘের আদিবাসী বা ‘ইন্ডিজেনাস ঘোষণা পত্রে’ এমন সব শর্তের উল্লেখ আছে যে, তা আমরা কেন অনেক দেশ মানতে পারবে না। এর ফলে বিশ্বের মাত্র ২৫টির মতো দেশ সে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। মূলত ওই ২৫টি দেশের অনেকগুলোতে ইন্ডিজেনাস জনগোষ্ঠীই প্রধান বা প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী। ফলে সেসব দেশে এ ঘোষণা পত্র অনুমোদন করতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশে এসব অনুমোদন করা বা মানা সম্ভব নয়। কেননা, এটি অনুমোদন করলে পাহাড় আর বাংলাদেশের থাকে না। সে কারণে সুগভীরভাবে ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছে।

ফলে যার অংশ হিসেবে একসময় বিচ্ছিন্নতাবাদের আন্দোলন করে আসা স্বশস্ত্র দলগুলো পার্বত্য চুক্তিতে নিজেদের উপজাতি ঘোষণা দিলেও এখন আদিবাসী সুবিধা নিতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেছে। সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আসছে যাতে করে বাংলাদেশ ‘আদিবাসী’ শব্দটি সাংবিধানিক ভাবে মেনে নেয়। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, আদিবাসী হিসেবে সংবিধানে তাদের নাম উল্লেখ না করলে যেন, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার কিছুতেই সুরক্ষিত হচ্ছে না। সংবিধানে আদিবাসী কথাটি উল্লেখ করলেই যেন সঙ্গে সঙ্গে দৈববলে তাদের অধিকার রক্ষা করা হয়ে যাবে! আবার ‘আদিবাসী’ শব্দটি বাংলায় ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় একটি ভূখন্ডের আদি বাসিন্দা। আদিবাসী তত্ত্বের পক্ষের অনেক গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহকে ‘বাংলাদেশের আদিবাসী’ বলে সম্বোধন করেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, চাকমা বা মারমারা যদি বাংলাদেশের আদিবাসী হন, তাহলে বাঙালিরা কী? বাঙালিরা কি তবে পরবাসী? বাঙালিরা এ ভূখণ্ডে বসবাস করছে ৪ হাজার বছরেরও বেশি। অথচ চাকমা বা মারমারা পাহাড়ে এসেছে সর্বোচ্চ ২ থেকে ৩শ বছর আগে। আদিবাসী শব্দটি প্রতিষ্ঠা করার পেছনে স্বার্থ যে আছে, এটি স্পষ্ট। যেমন, বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র দলগুলো এখন আন্দোলন করছে আদিবাসী স্বীকৃতির দাবিতে। অথচ তাদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল পৃথক জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে। যদিও আদতে ওই দাবিতে তারা আন্দোলন করেনি, তারা বরং চেয়েছে পাহাড় আলাদা করতে। কিন্তু আদিবাসী ও জাতিগোষ্ঠী তো এক কথা নয়। এখন আর তারা জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করে না। অর্থাৎ, তারা চাকমা বা মারমা বা ত্রিপুরা জাতির স্বীকৃতি চায় না! তারা চায় ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি। কিন্তু এক হিসেবে নিউজিল্যান্ডের মাউরিরা তো আদিবাসী। এখন মাউরি আর ত্রিপুরা কি এক জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে? অর্থাৎ এক অদ্ভুত যুক্তিহীন একটি বিষয় হচ্ছে এই আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি। কোনো যুক্তি ছাড়া স্রেফ আবেগের বশে বা গায়ের জোরে আদিবাসী শব্দটি প্রতিষ্ঠিত করতে অনেকে উঠেপড়ে লেগেছে। আর কতিপয় মিডিয়া ও কিছু সংগঠন আদিবাসী শব্দ নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে খেলা করছে। কিন্তু সরকার এখানে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে।

প্রশ্ন : সরকার তো এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। আপনি সরকার এবং মিডিয়াকে কিসের ভিত্তিতে দায়ী করছেন?

উত্তর : বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নাই এবং নৃগোষ্ঠীসমূহকে আদিবাসী না বলতে সংবিধানের আলোকে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আওয়ামী লীগ সরকার- একথা ঠিক। কিন্তু স্বয়ং সরকারের মন্ত্রী এমপিরাই এসব মানছে না। মিডিয়া ও কিছু কিছু সংগঠন কিভাবে সরকারি প্রজ্ঞাপন উপেক্ষা করে বার বার এই শব্দ ব্যবহার ও আদিবাসী নামে দিবস উদযাপন করছেন? নিশ্চয়ই সরকার এখানে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে, তা না হলে এ বিষয়ে মিডিয়া এত বাড়াবাড়ি করে কী করে। কারণ, ইতোমধ্যেই যে সকল মিডিয়া সরকারের অপছন্দের কাজ করেছে সে সকল মিডিয়াকে বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কী এবং তাদের প্রজ্ঞাপনের অবস্থানই বা কী তা আরো পরিষ্কার করা জরুরি।

আপনি দেখুন গত ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস গেল। খুব ধুমধাম করে গত কয়দিন আদিবাসী নামক দিবসটি উদযাপন হয়েছে পাহাড়ে এবং মিডিয়ায়। তখন প্রায় দুদিন মিডিয়াকে প্রায় দখলেই রেখেছে এই দিবসটির হেড লাইন ও কালারফুল সব ক্যামেরা চিত্র। টকশোগুলো ছিল সরব-তর্কিত কিছু ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে। চ্যানেলগুলো খুব দৌড়াচ্ছে কার আগে কে বেশি প্রোগ্রাম দেখাতে পারে দিবসটির! অথচ পাহাড়ে এক সময়ের গেরিলা নেতা, সশস্ত্র সংগঠক ও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় দীর্ঘকালের (টানা ১৮ বছর) জন্য নিয়োজিত চেয়ারম্যান জনাব সন্তু লারমা, উইপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারসহ অনেক অস্ত্রধারী সংগঠনের নেতাদেরকে দেখলাম আদিবাসী দিবস নিয়ে খুবই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৭ সালের আগে বা এর কিছুকাল পরেও কিন্তু এই নেতারা আদিবাসী নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। আদিবাসী দিবস পালনতো দূরের কথা উনারা কোনোদিন আদিবাসী ছিলেন তা মনেও করেননি, দাবিও করেননি। উনারা নিজেদেরকে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ইত্যাদি নামেই ডাকতে পছন্দ করতেন এবং উপজাতি বা বিশেষ ক্ষেত্রে জুম্ম জাতি দাবি করতে বেশি গর্ববোধ করতেন। কিন্তু হঠাৎ করে কী এমন ঘটনা এবং কারণ ঘটে গেল যে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে উল্লেখিত নামগুলো বাতিল করে দিলো? ইতিহাসকে পদদলিত করে আদিবাসী নামকরণে উনারা একযোগে লাফিয়ে উঠলেন। সাথে সাথে এ বিষয়ে নেমে গেলেন কিছু বিশেষ বিশেষ সুশীল, মিডিয়া, সাংবাদিক, বুদ্ধিবাদী ও সুশাসক। বিষয়টায় মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাটা খুবই স্বাভাবিক।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী সরকারের সঙ্গে অস্ত্রধারী সংগঠনের নেতা সন্তু লারমা উপজাতীয়দের পক্ষে পার্বত্য চুক্তি (শান্তি চুক্তি) স্বাক্ষর করেন। সেময় সন্তু বাবু ‘আদিবাসী’দের পক্ষে নয়, ‘উপজাতীয়দের’ পক্ষেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। আপনি দেখুন ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সন্তু বাবুর স্বাক্ষরিত চুক্তির মুখবন্ধে কী আছে।

চুক্তির প্রথম পাতায় (ক) সাধারণ- এর ক্রমিক ১ এ উল্লেখ আছে “উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন।” (খ) এর ক্রমিক ১ এ উল্লেখ রয়েছে “পরিষদের আইনে বিভিন্ন ধারায় ব্যবহৃত ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকিবে।” আরো উল্লেখ্য এরশাদ সরকারের সাথে ২১ সদস্য বিশিষ্ট উপজাতীয় নেতাদের একটি কমিটি উপজাতীয়দের পক্ষে “স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯” এ উপজাতি শব্দ ও উপজাতীয়দের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষে (কথাটি লিখিত) চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

সকল উপজাতীয় নেতাসহ সন্তু বাবুর কাছে অপরাপর সকল প্রশ্ন জমা রেখে আজ আমার একটি প্রশ্ন, মাত্র কয় বছর আগে পার্বত্য চুক্তিতে উপজাতীয়দের অধিকার সংরক্ষণে স্বাক্ষর করে এখন আদিবাসী দাবি করছেন কিভাবে? তবে কি পার্বত্য চুক্তিকে অস্বীকার করছেন? পার্বত্য চুক্তি ভুল ছিল?

প্রশ্ন : পাহাড়ে এনজিওদের কাজের বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উঠছে, আপনিও তাই বলছিলেন। তাদের আপত্তিজনক কাজগুলো কী?

উত্তর : প্রথমত, পাহাড়ের অনেক এনজিও একদিকে সাম্প্রদায়িকতা বজায় রাখতে সাধারণ বাঙালি-পাহাড়ির মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রাখার কাজ করছে। অন্যদিকে তারা ধর্মান্তকরণের কাজেও জড়িত। এজন্য অনেক এনজিওকে পাহাড় থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, পাহাড়ে উন্নয়নের নামে অনেক এনজিও এসেছে। কিন্তু এর সুফল আদৌ পাহাড়ের মানুষ পায় না। এমন সব ননসেন্সিয়াল খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, ভেবে অবাক হবেন। যেমন, জাতিসংঘের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান পাহাড়ে একটি প্রকল্পে গত কয়েক বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ঢেলেছে। এটি তাদের আনুষ্ঠানিক হিসাবেই আমি পেয়েছি। অনানুষ্ঠানিকভাবে আরও কত টাকা ঢেলেছে তা উপরওয়ালাই জানেন। দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়ে পাহাড়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু আপনি কি কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছেন পাহাড়ে? মানুষের ভাগ্যের চাকা কি ঘুরেছে? এ প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে আবার অনেক ছোট ছোট এনজিও জন্মেছে। এগুলোরও কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা বা অবদান নেই। পশ্চিমা দাতারা বিষয়টি হয় বুঝতে পারছে না, নয়তো বুঝেও কোন রহস্যজনক কারণে চোখ বুজে আছে। এসব এনজিওগুলোর বৈষম্যের কথাটিও কারো অজানা নেই। যেমন, বিদেশে বৃত্তি দেয়ার বেলায়, ঋণ বা সেবা দেয়ার বেলায় জাতিগতভাবে বৈষম্য করা হয়। এমন রেকর্ডও আছে, শিক্ষা জীবনে তৃতীয় বিভাগ পেয়েও অনেকে উন্নত দেশে বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করতে গেছে। পার্বত্য এলাকায় এনজিওবাজি এখন গুটিকয়েক মানুষের অবস্থা পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রশ্ন : সমতলের সঙ্গে পাহাড়ের রাজনীতির পার্থক্য কী?

উত্তর : সমতলের রাজনীতি আর পাহাড়ের রাজনীতির মধ্যে অনেক জটিল পার্থক্য আছে। প্রথমত- সমতলের রাজনীতি পাহাড়ের তুলনায় অনেক সাদামাটা। পাহাড়ের রাজনীতির মাঠ অনেক পিচ্ছিল। পাহাড়ের রাজনীতির ডেস্টিনেশনও অনেক দুর্গম। যেমন সমতলের রাজনীতি মানে, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। এর পরে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী। সমতলে নৌকা মার্কার কিংবা ধানের শীষের মার্কা নিয়ে নমিনেশন পেলেই হলো। আইদার আওয়ামী লীগ-বিএনপির মারামারি, হামলা-মামলা ইত্যাদি। কিন্তু পাহাড়ে শুধু মাত্র তা নয়। সমতলের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতের ট্র্যাডিশনাল রাজনীতিতে যা যা বিদ্যমান পাহাড়ের রাজনীতিতেও তা আছে। সেই সঙ্গে এখানে রয়েছে কিছু জটিল হিসাব-নিকাশ। স্থানীয় রাজনীতির ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মারপ্যাচ। এখানে রাজনীতির নামে আছে সশস্ত্র একাধিক সংগঠন। যেমন- সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস, তাদের সুধাসিন্ধু-গেরিলা মেজর পেলে বাবুর নেতৃত্বাধীন সংস্কারবাদী নামে বিদ্রোহী জেএসএস গ্রুপ, প্রসিত বিকাশ খিসার ইউপিডিএফ নামে ভিন্ন গ্রুপ। যারা এক দিকে সর্বদা ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করছে অন্যদিকে অস্ত্র হাতে দেশের সরকার ও স্থানীয়দের জিম্মি করে সুদূরপ্রসারি গেম করছে। দ্বিতীয়ত- তাদের দমন করতে সেনাবাহিনী সেখানে কাজ করছে। পাহাড়ের রাজনীতিতে সশস্ত্র গ্রুপগুলো যেমন একটি বড় ফ্যাক্টর। আবার সেনাবাহিনীরও পাহাড়ের রাজনীতিতে রয়েছে বিরাট ভূমিকা। তৃতীয়ত- এখানে রয়েছে দেশীয় একটি মহল এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী মহল। তারাও তাদের ডেস্টিনেশন পুরণের জন্য তাদের পছন্দের বা অপছন্দের লোকদের ক্ষমতায় বসাতে কুটনৈতিক তৎপরতা এবং টাকা পয়সা ব্যয়সহ বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখে। চতুর্থত- পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি রাজ্যের অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামঘেষা। সেসব রাজ্যে আবার বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ আছে। যারা পার্বত্য এলাকার অরক্ষিত স্বীমান্ত কাজে লাগিয়ে এদেশের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর শেল্টারে আত্মগোপনে থাকার প্রমান পাওয়া গেছে। পঞ্চমত- এখানের আইন কানুন সমতলের আইন কানুনের চেয়ে কিছুটা আলাদা। সমতলের জেলা পরিষদ আর এখানকার জেলা পরিষদগুলোর মধ্যেও রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। সমতলের জেলা পরিষদগুলো হলো ঠুটো জগন্নাথ। কিন্তু পাহাড়ের জেলা পরিষদগুলো অনেকটাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। চাকরির নিয়োগ, বদলি, প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। এছাড়াও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক পরিষদ, উন্নয়নবোর্ডসহ নানা প্রতিষ্ঠানকে আমলে নিয়ে রাজনীতি করতে হয়। এরপর সেখানে গণতান্ত্রিক ধারায় রাজনীতি করতে গিয়ে বিবাদমান অস্ত্রধারী গ্রুপগুলোর গুলির মুখে দিয়ে নিজেদের আইডলোজি নিয়ে জনগণের দ্বারে দ্বারে যেতে হয়। সমতলের একেকটি  গ্রামে যেখানে সহস্র লোক পাওয়া যায়, তেমনি কিন্তু পাহাড়ের গ্রাম গুলোতে পাওয়া যায় না।  পাহাড়ের লোকজন বিচ্ছিন্ন, তারা বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করে। এখানে এক গ্রামে ৪/৫ পরিবারের বসবাস তো আরেক গ্রামে ৫/৭ পরিবারের বাস। তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছাও জীবনের জন্য হুমকি। সেই সকল জনগণও থাকে ত্রিমুখী চাপে। নিজেদের পছন্দ অপছন্দের কথা যেমন মন খুলে বলতে পারে না। তেমনি ব্যালটের মাধ্যমেও প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। স্থানীয় সশস্ত্র গ্রুপগুলো নির্বাচনের আগেপরে তাদের ওপর জারি করে নিষিদ্ধ সব হুকুম। পাহাড়ে সরকার এবং সংবিধান তথা রাষ্ট্রীয় আইনের বাইরে অনেক কালা কানুন চলে।

প্রশ্ন : পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপের রাজনীতির কথা আসছে। তারা কোন আইডলোজিতে রাজনীতি করছে?

উত্তর : তারা বেসিক্যালি পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করার আইডলোজি নিয়ে রাজনীতি করে। বিদেশিদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। শুধু বিদেশিদের বললে ভুল হবে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকজন বুদ্ধিজীবী নামধারী, কয়েকটি মিডিয়া, প্রশাসনের একটি অংশ এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দলও তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে। বর্তমানে তাদের কর্মকাণ্ড চাঁদাবাজিকে ঘিরে। এক কথায় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো এ অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করা ও চাঁদাবাজি করে নিজেদের আখের গোছানো। কিন্তু তারা এটুকু বিবেচনা করছে না ছোট্ট একটা দেশকে কি করে ভাগ করবে।

প্রশ্ন : আপনি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের কথা বলছিলেন। কিন্তু সে প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দিতে সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছে। এর মাধ্যমে কি সে ষড়যন্ত্রের অবসান হয়নি?

উত্তর : বিচ্ছিন্নতাবাদী ষড়যন্ত্র থামানোর জন্যই এ চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির মাধ্যমে সশস্ত্র আন্দোলন তো থামেইনি, বরং আরো বেড়েছে। আগে যেখানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপ ছিল, সেখানে এখন ৩টি বিচ্ছিন্নতাবাদী  সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয়েছে। মানুষ আগে একমুখী চাপে ছিলো। আর এখন ত্রিমুখী চাপে আছে।

প্রশ্ন : এর পেছনে কারণ কী?

উত্তর : কারণ হলো ঐ চুক্তিটা যথাযথভাবে হয়নি। চুক্তির কিছু অংশ বৈষম্যমূলক, উষ্কানিমূলক, সার্বভৌমত্ববিরোধী এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যার ফলে, কিছু বিষয়ে সরকার এবং চুক্তি সম্পাদনকারী জেএসএস সন্তু গ্রুপ ছাড়া কেউই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সুতরাং এর মাধ্যমে বিভেদ আরো বেড়েছে। আগে একটি গ্রুপ চাঁদাবাজি করতো। আর এখন ৩টি গ্রুপ চাঁদাবাজি করছে।

চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আবার রাজনীতির নামে প্রকাশ্যে অবস্থান নিচ্ছে। যাদের উদ্দেশে এই চুক্তি করা হয়েছিলো, তাদের মধ্যেও অশান্তি অনেক বেড়ে গেছে। তাদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। আগে শুধু বাঙালিরা আক্রান্ত হতো। আর এখন প্রকাশ্যে পাহাড়িরা এক পক্ষ আরেক পক্ষকে গুলি করে মেরে ফেলছে। মাঝ থেকে তাদের অস্ত্রের এবং আয়েশী জীবন জাপনের অর্থের যোগান দিতে গিয়ে বাঙালিদের নাভিশ্বাস উঠেছে। সাধারণ পাহাড়িরাও এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

প্রশ্ন : তার মানে আপনি পাহাড়ে উপজাতীদেরে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের জন্য পার্বত্য শান্তিচুক্তিকে দায়ী করছেন?

উত্তর : হ্যাঁ, আমি পার্বত্য চুক্তিকে দায়ী করছি। কারণ এ চুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। অপরদিকে এ চুক্তিতে পার্বত্য এলাকায় বাঙালিদের উপস্থিতি এবং অস্তিত্বকে মারাত্মকভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। পার্বত্য বাঙালিদের রাষ্ট্রীয় অধিকার, সুযোগ সুবিধা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয় চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী সরকার গড়ে উঠেছে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সার্বভৌমত্বের সাথে যায় না।

প্রশ্ন : সেটা কী রকম?

উত্তর : পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে এ অঞ্চলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। কোনো কারণে যদি প্রয়োজন হয় তবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সেনাবাহিনী দেশের যেকোনো স্থানে মুভ করতে পারবে। কিন্তু এ চুক্তির ধারামতে পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনী তা পারবে না। বরং সেখানে সেনাবাহিনীকে মুভ করতে হলে এক সময়ের গেলিরা নেতা আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের নির্দেশ লাগবে। এতে করে কি প্রমান করে না, পার্বত্য এলাকায় রাষ্ট্রীয় আধিপত্ত নেই। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে পার্বত্য এলাকায় রাষ্ট্রপতির নয়, হুকুম চলবে আঞ্চলিক পরিষদ নামে ভিন্ন সরকারের। যা আমাদের সংবিধান অ্যাপ্রুভ করে না।

শুধু তাই নয়। রাষ্ট্রের একটা প্রতীকী ক্ষমতা আছে। দেশের কোনো জায়গা বা কারো জায়গা রাষ্ট্রের প্রয়োজন হলে রাষ্ট্র তা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে অধিগ্রহণ (অ্যাকোয়ার) করতে পারবে। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির শর্তে রাষ্ট্রের সেই অধিকারও খর্ব হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় কোনো জায়গা রাষ্ট্রের প্রয়োজন হলেও রাষ্ট্র তা সরাসরি অধিগ্রহণ করতে পারবে না। যদি কেউ পারে তা হলো চুক্তিবলে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ। এটাও কি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব খর্বের উদাহরণ নয়?

প্রশ্ন : এই ক্ষমতাধর আঞ্চলিক পরিষদের গঠন প্রক্রিয়া এবং কর্মকাণ্ড কী?

উত্তর : আঞ্চলিক পরিষদ সৃষ্টি হয়েছে পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে। চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার এবং জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বা তার সশস্ত্র গেরিলা নেতা সন্তু লারমা। সেই সন্তু লারমা ১৯৯৮ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদে বসে আছেন। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তিনি আজীবন ঐ চেয়ারে থাকবেন।

প্রশ্ন : চুক্তির আইনে তো প্রতি পাঁচ বছর পরপর গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের বিধান রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছর কী করে আছেন?

উত্তর : আইনে তো নির্বাচনের কথা আছেই। কিন্তু নির্বাচন তো হচ্ছে না। সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সন্তু লারমারা সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দ্বৈত ভোটার তালিকাসহ নানান জটিলতার কথা বলে এ নির্বাচন থামিয়ে রাখা হয়েছে।

প্রশ্ন : দ্বৈত ভোটার তালিকা কী ধরনের দাবি?

উত্তর : দ্বৈত ভোটার তালিকা বেসিক্যালি নাগরিকদের এলিট শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করার মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা। তারা নিজেদের আদিবাসী দাবি করে পাহাড়িদের জন্য আলাদা ভোটার তালিকা প্রণয়নের দাবি করেছে। সে ভোটার তালিকা অনুযায়ী পার্বত্য পরিষদগুলোতে (৩টি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও ১টি আঞ্চলিক পরিষদ) নির্বাচনে ভোট প্রয়োগ করবে। যা স্পষ্টত রাষ্ট্রকে দুই ভাগে বিভক্ত করার নীল-নকশা। অথচ এই দাবির সঙ্গে ষযড়ন্ত্রের অংশ হয়েছেন আমাদের দেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবী নামধারী দেশের শত্রু এবং বিদেশি মিশনারীসহ কিছু ব্যক্তি।

প্রশ্ন : ১৯৯৭ সালে সংসদে পার্বত্যচুক্তি সম্পাদনের সময় আপনার দল বিএনপি বিরোধী দলে ছিল। সংসদে আইন পাশে বিরোধিতাও করেছিল। কিন্তু পরে এর বিরোধিতা করে তেমন কোনো কর্মসূচি নিতে দেখা যায়নি।

উত্তর : বিএনপি চুক্তি স্বাক্ষরের আগে-পরে বড় এবং ছোট অনেকগুলো কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু একটা বিষয় মানতে হবে। কোনো সরকার সংসদে একটা চুক্তি পাশ করলে পরবর্তীতে অন্য কোনো সরকার বা দলের ঐ চুক্তি থেকে সরে আসাটা ডিফিকাল্ট। বিএনপির জন্য এটা একটা বড় সমস্যা বা বাধা ছিল।

প্রশ্ন : কিন্তু যেসকল ধারা-উপধারা নিয়ে বিএনপি বিরোধিতা করেছিল, পরবর্তীতে সেগুলোও সংশোধন করেনি।

উত্তর : ঐ যে বললাম, সেটা ডিফিকাল্ট ছিল। তবুও বিএনপি চেষ্টা করেছে, চুক্তিটাকে রয়ে-সয়ে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য। চেষ্টা করে নাই তা ঠিক নয়।

প্রশ্ন : সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে সন্তু লারমা প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু মাঝে মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন না করার অভিযোগে দেখি তিনি আবারো হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার কথা বলেন। পাহাড়ের নেতা হিসেবে এ বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন?

উত্তর : এটা তো তার এবং তাদের ট্র্যাডিশন, স্ট্যান্ডবাজি। হুমকি দিয়ে, গুলি করবো, অস্ত্র হাতে তুলে নিব ইত্যাদি নানা কথা বলে সুবিধা আদায় করা। আপনি যদি একটু পেছনে দেখেন, তাহলে বুঝবেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলো। তখন আজকের বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশে পড়ে। কিন্তু ’৪৭ সালে তারা পাকিস্তানের বিরোধিতা করে ইন্ডিয়ার পতাকা উড়িয়েছিল। তারপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যখন সারা বাংলা এক হয়ে আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়ী করলো, তখন মাত্র একটি আসনে আওয়ামীলীগ পরাজিত হয়। আর সেই আসনটি হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদীয় আসনটি। এখানে লারমাদের পূর্বনেতা বর্তমান চাকমা সার্কেলচীপ ব্যরিস্টার দেবাশীষ রায়ের বাবা তৎকালীন চাকমা সার্কেল চীফ ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের পক্ষের ছিলেন। পাকিস্তানের মাটিতে প্রয়াত ত্রিদিব রায়, মানবেন্দ্র লারমা এবং সন্তু লারমাসহ চাকমা নেতারা সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয়। তাদের সহায়তা করে এরা রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পার্বত্য এলাকার বাঙালিরা সেদিন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবে তখন উপজাতীয়দের মধ্য থেকে চাকমা সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গুটি কয়েক মারমা, ত্রিপুরা ও অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্টীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। অবশেষে যখন দেশ স্বাধীন হয় তখনও তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের পরিবর্তে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ায়। তারা সব সময় ধরাকে সরাজ্ঞান করে। এজন্য অবশ্যই বাংলাদেশের সরকারগুলোই দায়ী। সরকারের দায়িত্ব এদেরকে নিরস্ত্র করা। কিন্তু সরকার সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না। সরকারের পক্ষে কি এদের নিরস্ত্র করতে এতো সময় লাগে?

প্রশ্ন : আপনি সন্তু লারমা, ত্রিদিব রায়দের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিতর্কিত ভূমিকার কথা বলছেন। আরেকটু পরিষ্কার করে বলবেন?

উত্তর : ত্রিদিব রায় তো দেশ স্বাধীনের সময় পাকিস্তানি সোলজারদের সঙ্গেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। তিনি ২০১২ সালে পাকিস্তানেই মারা যান। সে পর্যন্ত তিনি সেদেশের মন্ত্রী মর্যাদায় সম্মানিত হয়েই ছিলেন। তাকে সেদেশে বলা হতো উজিরে খামাকা (কর্মহীন মন্ত্রী)। মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে সে পাকিস্তানের হয়ে বিভিন্ন দেশের দূতাবাশে বাংলাদেশের বিরোধিতা করতে  অ্যাম্বাস্যাডরের দায়িত্বেও ছিলেন। এই সন্তু লারমারা ছিল তার অনুসারী। তারা সব সময় স্রোতের বিপরীতে চলে। দেশ স্বাধীনের পরেও যখন সবাই আওয়ামীলীগে ভোট দিয়েছে তখন তারা জাসদের প্রার্থী উপেন্দ্র লাল চাকমাকে নির্বাচিত করেছে।

প্রশ্ন : আপনার কথা থেকে দেখা যায়, উপজাতীরা আওয়ামী লীগবিরোধী। কিন্তু যতদূর জানা যায়, তারা তো আওয়ামী লীগের রাজনীতিকেই বেশি পছন্দ করেন।

উত্তর : এটা মূলত পাহাড়িদের একটা ভুল কনসেপ্ট ছিল। এটাও তাদের স্ট্যান্ডবাজি। আমি আগেও বলেছি, তারা দেশভাগের সময় পাকিস্তানের বিরোধিতা করে ইন্ডিয়ার পতাকা উড়িয়েছে। অথচ স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশকে অস্বীকার করে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছে। শেখ সাহেবের জীবদ্দশায় তার বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের বিরোধী প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। ঠিক তেমনি যখন সারাদেশ স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছে, তখন তারা এরশাদের পক্ষাবলম্বন করেছে। ’৯১ সালে যখন বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে তখন তারা আবারো স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আওয়ামীলীগের সাথে গিয়েছে।  স্রোতের বিপরীতে অবস্থান নেয়াটা তাদের ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ২০০১ সালের পরে সে পরিস্থিতি আবার বদলে গিয়েছে। আমি যখন সংসদ সদস্য হলাম, তখন আমি তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। এখন পার্বত্য এলাকার অনেক পাহাড়ি বিশেষ করে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছে।

প্রশ্ন : সমতলের জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। বেশকিছু বিভাগের সর্বময় ক্ষমতার মালিক পরিষদ। কিন্তু দীর্ঘ ২৬ বছর আগে নির্বাচন হলেও এর মধ্যে আর তা হয়নি। জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় জমা হয়েছে অনিয়ম দুর্নীতির অনেক অভিযোগ। নির্বাচন না হওয়ার কারণ কী?

উত্তর : হ্যাঁ, সমতলের আর পাহাড়ের জেলা পরিষদের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে। আইনও আলাদা। সমতলের জেলাপরিষদগুলো হলো ঠুটো জগন্নাথ। কিন্তু পাহাড়ের ৩ জেলার ৩টি পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রচুর ক্ষমতার মালিক।

পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন তদারক, বাস্তবায়ন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রকৌশল, ভূমি, মৎস্য, সমবায়, শিল্পকলা একাডেমী, সমাজকল্যাণ, যুব উন্নয়নসহ বেশকিছু বিভাগের সর্বময় ক্ষমতার মালিক পার্বত্য জেলা পরিষদ। আইনবলে পরিষদের নিয়ম অনুযায়ীই এ বিভাগগুলো পরিচালিত হয়। সরকার এসব পরিষদের নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও সশস্ত্র গ্রুপগুলোর অপতৎপরতায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ, জেলা পরিষদের নির্বাচন হলে পর্যায়ক্রমে আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হবে। আর তাই যদি হয় তাহলে বিনা নির্বাচনে সন্তু লারমার টানা ১৮ বছর বসে থাকা গদিটা হারাতে হবে। ফলে ঐসব প্রতিষ্ঠান সরকার নিয়োগকৃত লোকজনই পরিচালনা করছে। সেখানে কোনো জবাবদিহিতা নেই। সরকারকে খুশি রাখতে পারলেই হলো। জবাবদিহিতামূলক জনপ্রতিনিধি না থাকায় শত-সহস্র কোটি টাকার হরিলুট হয়।

কৌশলে দ্বৈত ভোটার তালিকা এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের নামে বাধা-বিপত্তি তুলে এ নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু নির্বাচন হলে দুর্নীতির হরিলুট এতটা হতো না।

প্রশ্ন : সরকারের পক্ষ থেকে তো পরিষদগুলো তদারক করার জন্য পার্বত্য মন্ত্রনালয় সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা কি দায়িত্ব পালন করছে না?

উত্তর : পার্বত্য মন্ত্রনালয় মূলত বরাদ্দ দেয়। এসব আর তদারকি হয় না। অনিয়ম দুর্নীতির কোনো তদন্ত যেমন হয় না তেমন কোনো শাস্তির ব্যবস্থাও নেয়া হয় না। পরিষদের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারির নিয়োগ, বদলি, শাস্তি এসব কোনো কিছুতেই মন্ত্রনালয়ের ক্ষমতা নেই বললেই চলে।

প্রশ্ন : নির্বাচনবিহীন চলতে থাকা পার্বত্য জেলা পরিষদে বিএনপির আমলেও সরকারি নিয়োগ প্রাপ্তরা দায়িত্ব পালন করেছেন। তখনও অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।

উত্তর : তখন অনিয়ম দুর্নীতি হয়নি, এভাবে বলা যাবে না। কম-বেশি তখনও হয়েছে। আইনগত কিছু সমস্যা তো তখনও ছিল। তবুও আমাদের সময়ে আইনের বাইরে গিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিষদগুলোতে গড়ে ওঠা সিস্টেমগত কারণে তা পুরোপুরিভাবে রোধ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

প্রশ্ন : পিছিয়ে পড়া পাহাড়ির জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির প্রচলন করে সরকার, যা অনেক দেশেই আছে। কিন্তু পাহাড়ে কোটা সিস্টেম নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। কেন এ বিতর্ক?

উত্তর : বিভিন্ন দেশে এই কোটা সিস্টেম করা হয় কোনো পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্য। সে হিসেবে পার্বত্য এলাকায় একই আলো-বাতাশে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠীগুলোকে বিভক্ত করে একটি অংশকে বঞ্চিত করে এই কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। যেমন পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান, প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান, উপমন্ত্রী মর্যাদায় ৩ পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইত্যাদি পদগুলো শুধুমাত্র পার্বত্য এলাকার উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের জন্য আলাদা কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অথচ পাহাড়ে যারা বাস করে, তাদের সকলের আর্থসামাজিক অবস্থা একই রকম। একই আলো-বাতাস, পানি গ্রহণ করছে। একই স্কুলের একই টিচারের শিক্ষা নিচ্ছে। একই টেবিল-বেঞ্চে বসে একই ব্ল্যাকবোর্ডের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করছে। তাহলে কেন বিভেদ? পার্বত্য এলাকার সকলের জন্যই একই ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছণীয়। কিন্তু পাহাড়ের এই বৈষম্যনীতির কারণে মূলত একটি মাত্র সম্প্রদায় (চাকমা) সকল সম্প্রদায়কে পেছনে ফেলে সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। আপনি জানলে অবাক হবেন, দেশের গড় শিক্ষার হার যেখানে ৬৫%, সেখানে বর্তমানে চাকমাদের শিক্ষার হার ৯৬% প্লাস। আর অন্য উপজাতীয়দের শিক্ষার হার তার দশ ভাগের একভাগও না। মানে মারমা বা ত্রিপুরাদের শিক্ষার হার মাত্র ৭-৮%। পক্ষান্তরে পার্বত্য বাঙালিদের শিক্ষার হারও মাত্র ৭%। উপজাতীয়দের জন্য বরাদ্ধকৃত কোটায় লিডারশিপ থেকে শুরু করে চাকরি, ব্যবসা এবং শিক্ষা সবক্ষেত্রে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে চাকমারা তা ভোগ করেছে এবং এখনও করছে।

প্রশ্ন : পার্বত্য বাঙালিরা সমতলের বাঙালির সাথে মিলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সংখ্যালঘু হিসেবে পিছিয়ে পড়া পাহাড়িদের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু না করলে তারা হয়তো এখনো পিছিয়েই থাকতো। এ বিষয়ে বিরোধিতা করা হচ্ছে কেন?

উত্তর : এ বিষয়ে বিরোধিতা করা না। মূলত পাহাড়বাসী হিসেবে সকলকেই একই সুযোগ দেয়ার দাবি এটি। সকলেই এগিয়ে যাক। সবার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটুক। দিনকে দিন কেউ এগিয়ে যাবে আর কেউ পিছিয়ে যাবে, এটা তো কোনো নীতি হতে পারে না। এখানে সমতা বা সমঅধিকার দরকার।

প্রশ্ন : প্রায়ই চাঁদাবাজির বিষয়ে শোনা যায়। কারা, কিভাবে এ চাঁদাবাজি করছে?

উত্তর : যারা এক সময় ঘোষণা দিয়ে বিচ্ছিনতাবাদের জন্য স্বশস্ত্র আন্দোলন করতো তারাই এখন ৩টা গ্রুপে ভাগ হয়ে চাঁদাবাজি করছে। বছরে প্রায় শতকোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। পাহাড়ে বসবাসকারি বাসিন্দাদের কেউ এ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বাঙালি-পাহাড়ি সবাই এর শিকার। সরকারি-বেসরকারি সকল ডেভেলপমেন্ট কাজের ক্ষেত্রেও চাঁদা দিতে হয়। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, ব্যক্তিগত বাসা-বাড়ি, এমনকি সেনাবাহিনীর সামনে দিয়ে যে সড়ক বানানো হচ্ছে সে সড়কের জন্যও তাদেরকে জায়গামত গিয়ে চাঁদা দিয়ে আসতে হয়। এক বোঝা লাকড়ির জন্য, একটা মুরগির জন্য, কলার ছড়ির জন্য, রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনগুলোর জন্য, বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য বিক্রির জন্য চাঁদা দিতে হয়। এমন কোনো সেক্টর নাই যার জন্য চাঁদা দিতে হয় না।

প্রশ্ন : সমতলের তুলনায় পার্বত্য এলাকায় সেনা-পুলিশ-বিজিবি সংখ্যায় বেশি আছে। তারপরও কী করে এমন নগ্ন চাঁদাবাজি চলছে?

উত্তর : এর জন্য আমাদের সরকারগুলোই দায়ী। আন্তর্জাতিক কিছু মোড়লদের জন্য সরকার অনেকাংশে নিরব ভূমিকা পালন করে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো নিরব ভূমিকা পালন করে।

প্রশ্ন : বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, পাহাড়ের সমস্যার মূলে ভূমি সমস্যা। এর সমাধান কী?

উত্তর : আসলে ভূমি সমস্যা মূল সমস্যা নয়। পাহাড়ের মূল সমস্যা হলো রাজনৈতিক। পাহাড়কে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছন্ন করার রাজনৈতিক সমস্যা। ভূমি সমস্যাকে মূলত আর্টিফিসিয়ালি তৈরি করা হয়েছে। এটা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক সমস্যা। এটা বর্তমানে চাঁদাবাজির সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে। শতকোটি টাকার চাঁদাবাজি করার জন্যই এখন ভূমি সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা জিইয়ে রাখা হয়েছে। কারণ তাদের মূল টার্গেট কিন্তু এ অঞ্চলকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। আর সেই টার্গেটকে ঘিরেই সব সমস্যা।

প্রশ্ন : কিন্তু ভূমি সমস্যাকে ঘিরে প্রতি নিয়ত বাঙালি-পাহাড়ির মধ্যে দন্দ্ব-সংঘাত লেগে আছে। আপনি এটা কিভাবে অস্বীকার করবেন?

উত্তর : সেটাও এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সৃষ্টি করছে। তারা ভূমি সমস্যাকে হাইলাইট করে তাদের অপকর্মগুলোকে আড়াল করে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন : পাহাড়িদের অভিযোগ তাদের প্রথাগত ভূমি অধিকার রক্ষা পাচ্ছে না।

উত্তর : বাংলাদেশের আইনে তথা সংবিধানে এর কোনো ভিত্তি নেই। দেশে একটি ভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি আছে। আপনি একদিকে দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার কথা বলবেন, আবার অন্যদিকে প্রথাগত অধিকারের কথা বলবেন, তা তো হয় না। এখন মূলত কথা হচ্ছে আইনগতভাবে যার কাছে জায়গার দলিলপত্র আছে সেই সে জায়গার মালিক।

প্রশ্ন : পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের একটা অংশের গুচ্ছগ্রামে মানবেতর জীবন জাপনের চিত্র দেখা যায়। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এ ব্যবস্থার অবসান হচ্ছে না কেন?

উত্তর : গুচ্ছগ্রামগুলো মূলত ১৯৮৬ সালে সৃষ্টি হয়েছে। তৎকালীন সময় স্বশস্ত্র সন্তুবাহিনীর হত্যা, অত্যাচার- নির্যাতন, জ্বালাও-পোড়াও বেড়ে যায়। নিরাপত্তা বাহিনী বিস্তীর্ণ এলাকায় নিরাপত্ত্বা দিতে পারছিল না। সেই প্রেক্ষিতে মানুষকে গুলি থেকে রক্ষা করতে নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিদের স্ব স্ব বসতবাড়ি থেকে উঠিয়ে এনে এক বছরের জন্য এ গুচ্ছগ্রামে বসানো হয়। তখন বলা হয় এক বছরের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখন তাদের বসতবাড়ি, বাগান-বাগিচা, জমি-জমায় ফিরিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু বাঙালিদের এখনো সেই গুচ্ছগ্রাম বন্দিশালা জীবনের অবসান ঘটেনি। গুচ্ছগ্রামবাসী তাদের বৈধ জায়গা-জমি ফেরত পায়নি। সেগুলো এখন অবৈধ অস্ত্রধারীদের দখলে চলে গেছে। সেখানে তাদের বাগান-বাগিচা, চাষাবাদের জায়গা জমি অনাবাদি পড়ে আছে। তাদের সন্তানরা ঠিকমত শিক্ষার আলো পায়নি। ফলে একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হয়ে বেড়ে উঠেছে গুচ্ছগ্রামের বাঙালিরা।

প্রশ্ন : যতদূর জানি পাহাড়ে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে একটা সম্প্রীতি ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা বিভেদে রূপ নিয়েছে। এ বিভেদের শুরুটা কবে এবং কীভাবে?

উত্তর : এ বিভেদের শুরু হয়েছে বেসিক্যালি শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের আমল ১৯৭২-৭৪ থেকে। ধীরে ধীরে এ বিভেদ বেড়েছে। তবে আমরা আমাদের সরকারের সময়গুলোতে এ বিভেদ কমাতে চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন : সেটা কী করে?

উত্তর : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে পাহাড়িদের একটি প্রতিনিধি দল শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে উপজাতীদের জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতিসহ তাদের কিছু দাবি দাওয়া তুলে ধরেন। তখন শেখ সাহেব পাহাড়িদেরকে বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন। সেই থেকে তারা সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলনের পথে নামে।

প্রশ্ন : এটা তো রাজনৈতিক বিভেদের কথা বলছেন? সাধারণ বাঙালি-পাহাড়ির মধ্যে যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ছিল, সেটা কীভাবে নষ্ট হলো?

উত্তর : সেটা আসলে নিজে থেকে নষ্ট হয়নি, নষ্ট করা হয়েছে। ’৭২-৭৩ সালে সশস্ত্রগ্রুপ সৃষ্টি হওয়ার পর তাদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করে। তারা এটা বাস্তবায়নের জন্য সাধারণ বাঙালি গ্রামে জ্বালাও-পোড়াও, খুন, অপহরণ শুরু করে। আবার বাঙালিদের মধ্য থেকে উশৃঙ্খল যুবকরা ক্ষিপ্ত হয়ে পাহাড়ি গ্রামে হামলা করেছে। বাঙালিদের সাথে দূরত্ব বাড়াতে কোথাও কোথাও সশস্ত্র গ্রুপগুলো পাহাড়ি গ্রামে ছদ্মবেশে হামলা করেছে। এভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাঙালি-পাহাড়িদের বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়ে ধীরে ধীরে এই বিভেদ সৃষ্টি করেছে।

প্রশ্ন : এ বিভেদ দূর করে পুনরায় সম্প্রীতি স্থাপনের উপায় কী?

উত্তর : উপায় হচ্ছে সরকারকে এখানে কঠোর হতে হবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি কারীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। যাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র আছে, অভিযান পরিচালনা করে সেগুলো উদ্ধার করতে হবে। অবৈধ অস্ত্রধারীদের নিরস্ত্র করতে হবে। সেখানে অস্ত্রধারীদের সঙ্গে প্রশাসন মিষ্টি মিষ্টি কথা বললে সম্প্রীতি হবে না। অস্ত্রধারীদের নিরস্ত্র করলে সাধারণ বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে ভীতি কমে আসবে। দূরুত্বও কমে আসবে। পরস্পরের আস্থা প্রতিষ্ঠার জায়গা তৈরি করতে হবে। তবে আসল কথা হলো অস্ত্রধারীদের নিরস্ত্র করতে হবে। কোনো সরকারই অস্ত্রধারীদের নিরস্ত্র করছে না।

প্রশ্ন : বিএনপি যখন সরকারে ছিল, তখন আপনি সংসদ সদস্য ছিলেন। সে সময় আপনি এবং আপনার সরকার কী ধরনের ভূমিকা রেখেছেন?

উত্তর : আমাদের সময়ে এতোটা নৃশংস, অমানবিক অস্ত্রবাজি হয়নি। তখন এই অস্ত্রবাজরা আমাদের কাউন্ট করতো, সংযত ছিলো। সেই সময় অস্ত্রের ব্যবহার খুব কম ছিল।

প্রশ্ন : কিন্তু অস্ত্রের ব্যবহার কম থাকলেও তাদের নিরস্ত্রকরণের উদ্যোগ কিন্তু নেয়া হয়নি!

উত্তর : নিরস্ত্রকরণের চেষ্টা করা হয়নি তা নয়। আমরা চেষ্টা করেছি। কিছুটা করাও হয়েছে। তখন দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে বড় বড় অস্ত্র ভাণ্ডার উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু আন্তর্জাতিক মোড়লদের চাপ, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের প্রপাগান্ডা এবং কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের সহায়তায় তা বেশিদূর এগোতে পারেনি। কিন্তু টেকনিক্যালি আমরা অনেকদূর এগিয়েছিলাম। আমাদের পাহাড়ের প্রতি দেশের ম্যাক্সিমামেরই ইন্টারেস্ট রয়েছে।

প্রশ্ন : এর কী কারণ আছে বলে মনে করেন?

উত্তর : পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। দেশে যদি একটা দুর্বল সরকার থাকে তাহলে সেই বিদেশি শক্তিগুলোর জন্য সুবিধা হয়। যেমন ধরুন আফগানিস্তান যেভাবে চলছে। তার মতো যদি একটি পুতুল সরকার তৈরি করতে পারেন, তাহলে এ সম্পদগুলো লুটেপুটে নিতে পারবে। আর এজন্য তারা পার্বত্য এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। আবার বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে একটি বড় দেশ। এখানকার বাজার দখলের প্রতি সবার একটা বাণিজ্যিক দৃষ্টিও রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে নিকটে রয়েছে সমুদ্রবন্দর। চারপাশে রয়েছে চীন, ভারত, মিয়ানমারসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। এসব ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোকে ঠেকাতে, এ সুযোগকে কাজে লাগাতে একটি সাম্রাজ্যবাদী মোড়ল রাষ্ট্র চাচ্ছে এখানে সামরিক ঘাটি গড়ে তুলতে।

প্রশ্ন : পার্বত্য এলাকার বড় অংশজুড়ে ইন্ডিয়ান সীমান্ত। চীন, মিয়ানমারও নিকটবর্তী। পার্বত্য এলাকা আক্রান্ত হলে চাপে পড়তে পাড়ে তারা। ফলে এমন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন কি সম্ভব হবে?

উত্তর : পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে ইন্ডিয়াও তার মতো রাজনীতি করে। চীনও চাচ্ছে তার মতো করে এখানে একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। দূরের এবং কাছের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর কেউ থেমে নেই।

প্রশ্ন : পার্বত্য চট্টগ্রাম অপরূপ সৌন্দর্য্যে ভরপুর। পৃথিবীর মানুষের একটা বড় অংশ পর্যটক। পর্যটন খাত দিয়ে অনেক দেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। আমাদের দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে এমন সম্ভাবনা কতটুকু?

উত্তর : পর্যটন খাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিপুল সম্ভাবনা বিদ্যমান। পাহাড় কোনো কৃত্রিম সৌন্দর্য নয়। এটা স্রষ্টার সৃষ্টি, প্রাকৃতিক। নেপালের মতো ছোট্ট দেশ, তাদের মূল উপার্জনের জায়গা হলো পর্যটন। কানাডার পর্যটন মাত্র একটি ঝর্ণাকে ঘিরে, নায়াগ্রা ফলস। এটা দিয়ে তারা লক্ষ-কোটি ডলার আয় করছে। আর আমাদের দেশের পার্বত্য এলাকায় সেরকম অসংখ্য ঝর্ণা আছে। আরো কত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু অস্ত্রধারী গ্রুপগুলো এ শিল্পকে অগ্রসর হতে দিচ্ছে না। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রশ্ন : তারা কেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে? সরকার কি ভূমিকা রাখছে?

উত্তর : কারণ, পর্যটন শিল্পের বিকাশ হলে মানুষ স্বাবলম্বী হবে। মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে অপরাজনীতির নেতারা সেটা হতে দিচ্ছে না। কারণ তাদের ভয়, পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটলে, মানুষ স্বাবলম্বী হলে তাদের জন্য অস্ত্র ধরবে কে। সেজন্য তারা এ শিল্পের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। সরকার চেষ্টা করে। কিন্তু নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সেভাবে পেরে ওঠে না। অবশ্য পেরে ওঠে না বললে ভুল হবে, সেভাবে চেষ্টা করে না।

প্রশ্ন : পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপনে আপনার কী ধরনের ভূমিকা ছিল?

উত্তর : আমি সব সময় সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের চেষ্টা করেছি। যারা অস্ত্র দিয়ে সাধারণ বাঙালি-পাহাড়িকে জিম্মি করে রেখেছে আমি তাদের ঘৃণা করি। তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। বিভিন্ন সময় যারা আহত হয়েছে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।  কোনো এক পক্ষ হামলার ঘটনা ঘটালে ক্ষতিগ্রস্তদের বুঝিয়েছি পাল্টা আক্রমণ না করতে। এসব করে শান্তি আসে না। এক সময় মানুষ আমার কথায় সাড়া দিতে শুরু করেছে। এসব কারণে নিরস্ত্র পাহাড়িরা দিনদিন আমার সঙ্গে এক হয়ে রাজনীতি করতে শুরু করে। আর এটাই প্রমাণ করে আমি পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের জন্য কাজ করেছি।

প্রশ্ন : কথিত আছে সন্তু লারমা, সুধাসিন্ধু চাকমা এবং  প্রসিত বিকাশ খীসাসহ অন্য নেতারা শুধুমাত্র আপনার নামে ভয় পায়। অন্যভাবে যদি বলি আপনাকে পাহাড়ের গডফাদার বলা হয় কেন?

উত্তর : এক সময় এমন পরিস্থিতি ছিল। আমাকে নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার-প্রচারণা চালানো হতো। এটা হলো একটা প্রতিহিংসা। সন্তু লারমার মত লোক যারা ভারি ভারি অস্ত্র ব্যবহার করে, সুধাসিন্দু চাকমা, প্রসিত বিকাশ খীসার মতো লোকরা অস্ত্রধারী সংগঠন চালায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সেনাবাহিনী নিয়োজিত আছে। মূলত গডফাদার হলো তারা । আর এমতাবস্থায় যদি আমাকে গডফাদার বলা হয় তাহলে সশস্ত্রগ্রুপের নেতাদের কী বলবে? গ্র্যান্ড গডফাদার? আমার তো অস্ত্র নেই, সশস্ত্র কোনো সংগঠন নেই, সশস্ত্র কর্মকাণ্ডও নেই। তাহলে কে গডফাদার সেটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।  তবে মূল কথা হলো আমি পাহাড়ের ব্যাপক জনগোষ্টীকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি। ব্যাপক জনগোষ্ঠী আমার সাথে ঐক্যবদ্ধ আছে। যার কারণেই ওদের ভয়। আমাকে যদি কেউ ভয় পায়, তাহলে সেটা আমার জনসমর্থণের কারণে। আমার অস্ত্র নাই ঠিক, কিন্তু জনসমর্থন আছে। সেটাই প্রতিপক্ষের ভয়। সাধারণ জনগণই আমার পুঁজি। আমি জনগণের রাজনীতি করি, আমার সাথে বিপুল জনগণ আছে বলেই তারা আমাকে ভয় পায়।

প্রশ্ন : অনেক কথা হলো, অনেক সময় দিলেন, ধন্যবাদ।

উত্তর : আপনাকেও ধন্যবাদ।

সৌজন্যে : আজ

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net