রবিবার, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৫

বেনজির ভুট্টো নিজেই ছিলেন একটি আন্দোলন

by ঢাকাবার্তা
বেনজির ভুট্টো

সুরেন্দর ভালাসাই ।। 

আমি শহীদ মুহতারামা বেনজির ভুট্টোর কাছ থেকে শেষ ইমেইলটি পেয়েছিলাম ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে। সেটা ছিল আমাদের প্রতিদিনকার প্রেস সামারির জন্য একটি নির্দেশনা, যা আমি ১৯৯৭ সাল থেকে ১০ বছর ধরে নিয়মিত প্রেরণ করতাম।

এই ইংরেজি সারাংশে সিন্ধি, উর্দু এবং ইংরেজি পত্রিকার নির্বাচিত খবর অন্তর্ভুক্ত থাকত। ওইদিনের সারাংশে একটি খবর ছিল, “পিপলস পার্টির নেতা সৈয়দ ফাইয়াজ শাহ (হায়দারাবাদ) এবং তার ৭ জন পরিবারের সদস্য সুপার হাইওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।”

তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার পক্ষ থেকে শাহকে একটি ‘গেট ওয়েল সুন’ চিঠি পাঠানোর জন্য। কিন্তু তার ইলেকট্রনিক স্বাক্ষরিত চিঠিটি পৌঁছানোর আগেই, তিনি আর আমাদের মাঝে ছিলেন না। নির্মম সন্ত্রাসীরা রাওয়ালপিন্ডিতে তাকে হত্যা করে এবং বিকাল ৬টা ১৬ মিনিটে তাকে শহীদ ঘোষণা করা হয়।

মাত্র দুই মাস আগে, করাচিতে একটি ভয়াবহ বোমা হামলা থেকে তিনি বেঁচে ফিরেছিলেন। ওই হামলায় ১৮০ জন পিপিপি কর্মী শহীদ হন এবং ৫০০ জন আহত হন, যাদের অধিকাংশ গুরুতরভাবে আহত হয়। কিন্তু হামলার পরের দিনই তিনি আহত জিয়ালাদের দেখতে হাসপাতালে যান।

পিপিপি মিডিয়া সেলের একজন অংশ হিসেবে, আমি তার সঙ্গে আরেকটি ঐতিহাসিক যোগাযোগ শেয়ার করতে চাই। ২০০৬ সালের শেষের দিকে, আমি তাকে লিখেছিলাম:
“ভারতে, বাবাসাহেব বি আর আম্বেদকরের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে ৩০ লাখ দলিত একসঙ্গে বুদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন। তারা মানবিক সমতা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছেন।

পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের নেতা হিসেবে, পাকিস্তানের দলিতদের আপনি কী পরামর্শ দেবেন যাতে তারা একই ধরনের অধিকার অর্জন করতে পারে?”

তিনি অত্যন্ত সদয়ভাবে এই ইমেইলটি সিনেটর তাজ হায়দারকে ফরোয়ার্ড করেন এবং পিপলস সেক্রেটারিয়েটে দলিত নেতাদের নিয়ে একটি কর্মশালা আয়োজন করে রিপোর্ট জমা দিতে বলেন।

বেনজির ভুট্টো

বেনজির ভুট্টো

২০০৭ সালে, শহীদ বেনজির ভুট্টো আমাকে সিন্ধু অ্যাসেম্বলির একটি সংরক্ষিত আসনে আবেদন করতে বলেছিলেন। আমি যখন তার কাছে অন্য এক দলিত রাজনৈতিক কর্মীর জন্য টিকিট চেয়েছিলাম, তখন তিনি অবাক হয়ে জানতে পারলেন যে আমি স্নাতক নই এবং মুশাররফ আমলে আবেদন করার যোগ্য ছিলাম না।

গত ১৭ বছর ধরে, ২৭ ডিসেম্বর ঘনিয়ে এলে আমার হৃদয় গর্ব ও দুঃখে ভরে ওঠে। শহীদ মোহতারমা বেনজির ভুট্টো— একজন নেতা যিনি স্থিতিশীলতার প্রতীক, জাতির মা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আশার বাতিঘর ছিলেন।

তার জীবনের শেষ দশকটি তার সঙ্গে কাজ করা আমার জন্য সর্বদা গর্বের বিষয় ছিল এবং চিরকাল থাকবে। সেই দিনগুলো এবং মুহূর্তগুলো, যা আমার স্মৃতিতে গভীরভাবে খোদাই করা, পাকিস্তান ও তার মানুষের প্রতি তার অবিচল প্রতিশ্রুতির সাক্ষী।

একটি পুরুষশাসিত সমাজ এবং প্রায়শই বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, শহীদ বেনজির ভুট্টো তার বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, সাহস এবং প্রজ্ঞার কোনো লিঙ্গ নেই।

তার সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা আজকের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। পত্রিকাগুলো জনমত গঠনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করত। আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি, কিভাবে তিনি আমার প্রস্তুতকৃত সংবাদ সারাংশ বিশদভাবে বিশ্লেষণ করতেন।

জাতীয় সমস্যাগুলোর প্রতি তার গভীর বোঝাপড়া এবং তার কৌশলগত, স্পষ্ট এবং সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া তার অতুলনীয় প্রতিভা এবং দূরদর্শিতা প্রকাশ করত। প্রতিটি সিদ্ধান্ত তিনি সাধারণ মানুষের সংগ্রামের কথা সর্বদা মনে রেখে সহানুভূতি দিয়ে গ্রহণ করতেন।

শহীদ বিবি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না— তিনি নিজেই একটি আন্দোলন ছিলেন। তার জীবন ছিল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বিজয়ের, বিরাট ত্যাগের এবং গণতন্ত্রের জন্য অবিচল সংগ্রামের কাহিনী। তার বিখ্যাত উক্তি— “গণতন্ত্রই সর্বোত্তম প্রতিশোধ”— তার বিশ্বাস এবং সংগ্রামের সারসংক্ষেপ।

ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যারা শহীদ বেনজির ভুট্টো মতো রূপান্তরমূলক ছিলেন। তার শাহাদাতেও তিনি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ন্যায় ও সমতার জন্য একটি অবিচল কণ্ঠস্বর হিসেবে স্থায়ী প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

সুরেন্দর ভালাসাই

সুরেন্দর ভালাসাই

আমার মহান নেতা এবং পরামর্শদাতার জীবনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে, তার উষ্ণ হাসি, তার দৃঢ় আত্মা এবং তার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচারপূর্ণ একটি সমৃদ্ধ পাকিস্তানের স্বপ্ন আমার হৃদয়ে গভীরভাবে অনুরণিত হয়।

শহীদ মুহতারামা বেনজির ভুট্টো চিরকাল ভাগ্যের কন্যা হয়ে থাকবেন। তার পথপ্রদর্শক আলো আমাদের ছায়াগুলো পেরিয়ে একটি উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে।

লেখক : সুরেন্দর ভালাসাই একজন পাকিস্তানি মেঘওয়াল দলিত সাংবাদিক, যিনি থারপারকার জেলার বাসিন্দা। তিনি আগস্ট ২০১৮ থেকে আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসনে সিন্ধ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে প্রকাশিত কলামটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সবজান্তা সমশের।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net