স্টাফ রিপোর্টার ।।
একই ব্যক্তি সরকারপ্রধান, দলপ্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না এবং টানা দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এ দুই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়নি বিএনপি। তবে এক বছরের বিরতি থাকলে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে বলে মত দিয়েছে দলটি। গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা করে বিএনপি প্রতিনিধিদল। আলোচনার পর জানানো হয়, মঙ্গলবার ফের বৈঠকে বসবে দুই পক্ষ।
রোববার জাতীয় সংসদের এলডি হলে সকাল ১১টায় শুরু হয়ে বিকাল ৫টায় বৈঠক শেষ হয়। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে একই ব্যক্তি দলপ্রধান ও সরকারপ্রধান হন, এটি গণতান্ত্রিক চর্চা। বিএনপি মনে করে, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে, তাহলে যারাই নির্বাচিত হবেন, তাদেরই সরকার গঠনের অধিকার থাকবে। একইসঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বজায় রেখে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কিছুটা বাড়ানোর প্রস্তাবে বিএনপি একমত হয়েছে। তবে বিএনপি চায়, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া বাধ্যতামূলকভাবে নিষিদ্ধ করা না হোক, বরং উন্মুক্ত রাখা হোক।
সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ গঠনের বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নতুন আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছে দলটি। এনসিসি (জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল) গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে বিএনপি, তাদের মতে এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রমে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা বা বহুত্ববাদ উল্লেখ ছিল না, সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। তবে কমিশনের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বিষয়গুলো যুক্ত করার প্রস্তাবে বিএনপি সম্মত হয়েছে।
সংবিধানে ইন্টারনেট প্রাপ্তিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে যুক্ত করার প্রস্তাবে বিএনপি একমত হয়েছে, তবে তারা মনে করে রাষ্ট্রের সক্ষমতা অনুযায়ী মৌলিক অধিকার নির্ধারণ করা উচিত। সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার প্রসঙ্গে বিএনপি বলেছে, অর্থবিল, আস্থা ভোট, জাতীয় নিরাপত্তা ও সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়ের বাইরে এমপিরা যেন স্বাধীনভাবে মতামত ও ভোট দিতে পারেন।
নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার প্রস্তাবেও বিএনপি একমত হয়েছে। তবে এমপি প্রার্থীর ন্যূনতম বয়স ২১ বছর নির্ধারণের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত করার প্রস্তাব নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে বিএনপি। তবে এসব বিষয় সংবিধানে নয়, আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে তারা। স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান গঠনের বিষয়েও বিএনপি একমত হয়েছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার পক্ষে বিএনপি আগের অবস্থান বহাল রেখেছে। তারা চায়, সংবিধানে দলীয় প্রতীক ছাড়া স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের বিধান যুক্ত করা হোক। সংবিধান সংস্কারের প্রায় সব বিষয়ে আলোচনা শেষ হলেও বিচার বিভাগ সংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা এখনো বাকি রয়েছে। পরবর্তী বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে বিএনপি বলেছে, এমপিদের স্বাধীনতা বাড়ানোর জন্য অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধনী ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ের বাইরে সবক্ষেত্রে এমপিদের স্বাধীনভাবে ভোট ও মত প্রকাশের সুযোগ থাকা উচিত। কমিশনের পক্ষ থেকেও প্রায় একই মতামত এসেছে, যদিও তারা শুধু অর্থবিল ও আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা রাখার পক্ষে।
বিএনপি প্রতিনিধি সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন খণ্ডে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রস্তাবনা, প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার ও আইনসভা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আজ নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ নিয়েও আংশিক আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন করে ‘নাগরিকতন্ত্রী’ বা ‘জনগণতন্ত্রী’ বাংলাদেশ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। জনগণ দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামটি গ্রহণ করেছে এবং এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও রয়েছে।
বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারে সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ। নির্বাচন, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ পাঁচটি কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা শেষ হয়েছে বলে জানান তিনি।
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। উপস্থিত ছিলেন সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার ও ড. ইফতেখারুজ্জামান। বিএনপি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন নজরুল ইসলাম খান; অন্য সদস্যরা হলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ, মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও আবু মো. মনিরুজ্জামান খান।