হামীম কেফায়েত ।।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার প্রবণতা বরাবরই তাকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে (Bangladesh) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও লুটপাটের বিষয়ে টুইট করে বলেছেন, “I strongly condemn the barbaric violence against Hindus, Christians, and other minorities who are getting attacked and looted by mobs in Bangladesh, which remains in a total state of chaos.” এ মন্তব্যে ট্রাম্প বাংলাদেশকে বিশৃঙ্খল দেশ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নানা হামলার শিকার। তার এ বক্তব্য সামাজিকমাধ্যমে প্রচারিত হলেও বাস্তবতাকে আড়াল করেছে এবং দেশে-বিদেশে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের (The Washington Post) “ফ্যাক্ট চেকার” ডেটাবেসের তথ্য অনুসারে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার চার বছরের প্রেসিডেন্ট মেয়াদকালে প্রায় ৩০,৫৭৩টি বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা দাবি করেছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় এ সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, যা তাকে “মিথ্যার কারিগর” হিসেবে পরিচিত করেছে। ট্রাম্পের ২০২০ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময়ে করা অনেক বক্তব্যই তথ্যভিত্তিক প্রমাণ ছাড়া বিভ্রান্তিকর দাবি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এ বক্তব্যগুলোর একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল—আমেরিকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও বিভাজন তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপ, অভিবাসন নিয়ে তার দাবি ও সতর্কতাগুলো বিভ্রান্তিকর ছিল এবং এতে করে একটি ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারেও ডোনাল্ড ট্রাম্প একই ধরনের বিভ্রান্তিকর কৌশল ব্যবহার করেন, যা অনেক সংস্থা যাচাই করে মিথ্যা বলে চিহ্নিত করেছে। পলিটিফ্যাক্ট এবং অন্য ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা তার বক্তব্যগুলোকে একাধিকবার যাচাই করেছে এবং বেশ কিছু মন্তব্যকে “মিথ্যা” বা “অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর” বলে উল্লেখ করেছে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য একটি অতি-উত্তেজনাপূর্ণ দাবি, যা কোনো সত্যতা ছাড়াই বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে নানামাত্রিক লঘু উদ্বেগ থাকলেও ট্রাম্পের বক্তব্য অতিরঞ্জিত ও ভিত্তিহীন। কোনো বিশ্বাসযোগ্য সংস্থা তার এ মন্তব্যকে সমর্থন করেনি এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে সেভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো সহিংসতার খবরও প্রকাশ পায়নি। ট্রাম্পের এ ধরনের বক্তব্যের ফলে শুধু বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং আমেরিকান এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু ভোটারদের কাছে এক ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব তৈরির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ট্রাম্প তার টুইটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi)) সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তার প্রশাসনের সময় ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ কৌশলকে অনেক সমালোচক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন, যা মূলত ভারতের বংশোদ্ভূত হিন্দু আমেরিকান ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার জন্য প্রচেষ্টার একটি অংশ।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানের কৌশল তার নির্বাচনী প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার এ ধরনের মন্তব্য দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং জনগণের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে। এতে করে তার সমর্থকরা একটি ভয় ও সন্দেহের পরিবেশে আবদ্ধ হন এবং রাজনীতিতে তথ্যভিত্তিক আলোচনার পরিবর্তে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারেই প্রাধান্য পায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৪ সালের নির্বাচনে হিন্দু আমেরিকান ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো বিষয় তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। বিশেষত, ভারতের বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস (Kamala Devi Harris) ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ভারতীয় আমেরিকানদের ভোটে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব বিস্তার করেন। এ কারণে ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ কমলা হ্যারিসকে নিয়ে তিনি আতঙ্কে থাকতেই পারেন। ট্রাম্পের এ টুইটটি, যেখানে তিনি বাংলাদেশকে এক ভয়ানক রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করেন, মূলত হিন্দু ভোটারদের মধ্যে বাংলাদেশবিরোধী ভাবনা জাগিয়ে তুলতে পারে। তার এ কৌশল, যা ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু ভোটারদের মন জয় করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, আসলে তার রাজনৈতিক প্রচারের একটি বড় অংশ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, তার প্রশাসনে এ ধরনের সহিংস ঘটনা কখনো ঘটত না এবং তিনি ভারতের সঙ্গে মিত্রতা আরো শক্তিশালী করবেন। ট্রাম্প ‘‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি ফিরিয়ে আনব” বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি মূলত তার “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির সঙ্গে হিন্দু আমেরিকানদের জন্য একটি বিশেষ বার্তা। বাংলাদেশ ও সংখ্যালঘুদের ওপর তার মন্তব্য কেবল যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কাছাকাছি যাওয়ার প্রচেষ্টা বলে মনে হয়।
সংক্ষেপে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাংলাদেশবিরোধী টুইট আসলে মার্কিন নির্বাচনে হিন্দু ভোটারদের কাছে টানার রাজনৈতিক কৌশল। ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে তার ইতিবাচক মনোভাব তাকে হিন্দু ভোটারদের কাছে পছন্দনীয় করে তুলতে চায়। কিন্তু এতে করে একটি জাতীয়তাবাদী মিথ্যা বার্তা প্রসারিত হয়, যা শুধু তার রাজনৈতিক লাভের জন্যই করা হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাংলাদেশ নিয়ে সাম্প্রতিক মন্তব্যটি তার রাজনৈতিক মিথ্যাচারের একটি অংশ হিসেবে দেখা যায়। এটি কেবল বিভ্রান্তি তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য শুধু দেশটির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব ফেলে না, বরং আমেরিকান রাজনীতিতেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ট্রাম্পের রাজনৈতিক বক্তব্য ও বক্তব্যের ধরন তাকে “মিথ্যার রাজা” হিসেবে পরিচিত করেছে, যা মার্কিন রাজনীতির জন্যও অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
প্রিয়া সাহা প্রসঙ্গ
প্রিয়া সাহা (Priya Saha), বাংলাদেশের একজন মানবাধিকার কর্মী এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ধরা নিয়ে আলোচনায় আসেন। তিনি ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছিলেন—বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রিয়া সাহা যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত একটি ধর্মীয় স্বাধীনতাসংক্রান্ত বৈঠকে যোগদান করেন। সেখানে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলেন। সেই বৈঠকে সাহা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্যাতনের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং দাবি করেন—বাংলাদেশে ৩৫ মিলিয়ন হিন্দুর মধ্যে ২৫ মিলিয়ন লোক তাদের ধর্মের কারণে বৈষম্যের শিকার।
প্রিয়া সাহা বলেছিলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতি সপ্তাহে হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ভিটে ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।” তিনি এ বিষয়টি ট্রাম্পের নজরে এনে বলেন যে, ‘‘এ অবস্থা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।’’ সাহার এ অভিযোগ ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয় এবং বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রিয়া সাহার অভিযোগকে “মিথ্যা” ও “অবৈজ্ঞানিক” বলে অভিহিত করেন এবং এ ধরনের অভিযোগের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধের কথা বলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেছিল, ‘‘প্রিয়া সাহা একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ বক্তব্য দিয়েছেন।’’
সাহার ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্কিত আলোচনায় পরিণত হয়। এ ঘটনার মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে আলোচনা নতুন করে শুরু হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে প্রিয়া সাহার প্রচেষ্টা কিছুটা সফল হয়, তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটি একটি জটিল ও বহিরাগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।