সোমবার, নভেম্বর ১৭, ২০২৫

লাহোরের গলির ছেলে থেকে মিডিয়া মোগল: মহসিন নকভীর গল্প

by ঢাকাবার্তা
মহসিন নকভী

সৈয়দ হাসসান ।।

লাহোরের ভাঙাচোরা রাস্তার এক কোণে, জরাজীর্ণ একটি এলাকার মাঝে, দাঁড়িয়ে আছে পাঁচতলা একটি ভবন। নীল রঙের চকচকে কাচে ঢাকা এই ভবনটি যেন কোনো বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর পাতা থেকে উড়ে এসে এখানে বসেছে। এর চারপাশের বিশৃঙ্খলা আর গুঞ্জনের মধ্যেও এটি এক আলাদা জগৎ। এই ভবনেই রয়েছে সিটি মিডিয়া গ্রুপের সদর দপ্তর—যেখান থেকে একটি মিডিয়া সাম্রাজ্য পরিচালিত হয়। এই সাম্রাজ্যের পেছনে রয়েছে একজন মানুষের গল্প, যার নাম সৈয়দ মহসিন রাজা নকভী। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি যা করেছেন, তা অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন কি সংকটের মুখে?

মহসিন নকভীকে দেখলে মনে হয় না তিনি কোনো শক্তিশালী মিডিয়া মোগল। বয়সের তুলনায় বেশি সফেদ চুল আর দুষ্টু হাসি নিয়ে তিনি যেন পাড়ার সেই প্রিয় মামা, যিনি সবার সঙ্গে হেসে গল্প করেন। তাঁর সদর দপ্তরের কাচের দেয়ালে ঘেরা সাধারণ অফিসে দাঁড়িয়ে তিনি ধৈর্য ধরে একজন তারকার সমস্যার কথা শোনেন। হাত পিছনে জড়িয়ে, মাথা নিচু করে তিনি মন দিয়ে শুনছেন, মাঝে মাঝে ফিসফিস করে আশ্বাস দিচ্ছেন। তাঁর এই নম্রতা কোনো ভান নয়—তিনি সত্যিই একজন সহজ-সরল মানুষ।

কিন্তু এই নম্রতার আড়ালে রয়েছে এক অসাধারণ মেধা। মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি এক দশক ধরে সংবাদমাধ্যমের জগতে রাজত্ব করছেন। তাঁর প্রথম সাফল্য সিটি৪২—লাহোরের স্থানীয় সংবাদের জন্য নিবেদিত একটি চ্যানেল—তাকে শহরের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। এরপর এসেছে ফয়সালাবাদের সিটি৪১, ইংল্যান্ডের ইউকে৪৪, সেরাইকি অঞ্চলের রোহি টিভি এবং জাতীয় স্তরের চ্যানেল ২৪। এছাড়া রয়েছে একটি উর্দু সংবাদপত্র। তিনি যা স্পর্শ করেছেন, তাই সোনা হয়েছে—অন্তত এতদিন পর্যন্ত।

২০০৯ সাল। লাহোরের কেবল নেটওয়ার্কে হঠাৎ একটি নতুন চ্যানেলের নাম শোনা যায়—সিটি৪২। নামটি খুব একটা অভিনব নয়, শুধু লাহোরের টেলিফোন কোড ‘০৪২’ থেকে নেওয়া। কিন্তু ধারণাটি ছিল বিপ্লবী—শুধু লাহোরের স্থানীয় সংবাদ নিয়ে একটি চ্যানেল। এটি ছিল এমন একটি চ্যানেল, যেখানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বুলেটিন, সকালের অনুষ্ঠান আর সব রকম খবর থাকত। কিন্তু এর বিশেষত্ব ছিল লাহোরের প্রতিটি গলি-ঘাটে ছড়িয়ে থাকা রিপোর্টারদের দল। বিয়ের খবর হোক, রাস্তার গর্ত হোক, সাহিত্য উৎসব হোক কিংবা হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ—সিটি৪২-এর ক্যামেরা সব জায়গায় পৌঁছে যেত।

মহসিনের এই চ্যানেল শুধু খবর পরিবেশন করত না, লাহোরের জীবনের ছবি তুলে ধরত। তাঁর রিপোর্টাররা ছিলেন এক ধরনের ‘সুপারহিরো’—মাইক্রোফোন হাতে দোকানে ঢুকে দুধের ভেজাল ধরতেন, ক্লিনিকে গিয়ে অনিয়ম উন্মোচন করতেন। এই সাহসী, কখনো কখনো বেয়াদব স্টাইল দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। সিটি৪২ এমন এক শক্তি হয়ে উঠেছিল যে, লাহোরে কেউ কিছু গোপন করার আগে দুবার ভাবত—যদি চ্যানেলের ভ্যান এসে হাজির হয়!

লাহোরে জন্ম নেওয়া মহসিন ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন। মামার কাছে বড় হয়ে তিনি ক্রিসেন্ট স্কুলে পড়েন, যেখানে তাঁর নেতৃত্বের গুণ প্রকাশ পায়। তারপর গভর্নমেন্ট কলেজে পড়তে গিয়ে তিনি নেটওয়ার্কিং-এর ক্ষমতা দেখান—এমনকি সেসময় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে সিএনএনে ইন্টার্নশিপ করেন, যেখানে তিনি সাংবাদিকতার প্রথম স্বাদ পান। সিএনএন-এর সঙ্গে পাকিস্তানে ফিরে তিনি প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন, রাজনীতিবিদ আর সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েন। আসিফ আলী জারদারি, মিয়া নওয়াজ শরীফ এবং গুজরাটের চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে তাঁর বন্ধন তৈরি হয়।

তাঁর পারিবারিক সম্পদ আর সিএনএন-এর আয় নিয়ে ৩০ বছর বয়সে তিনি সিটি৪২ শুরু করেন। ডিজিটাল সরঞ্জামে সজ্জিত এই চ্যানেল ছিল তাঁর স্বপ্নের প্রথম ধাপ। এরপর তিনি একে একে নতুন চ্যানেল আর সংবাদপত্র চালু করেন। তাঁর উর্দু সংবাদপত্রটি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়, যা স্থানীয় বিজ্ঞাপন থেকে আয় করে।

মহসিনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এসেছিল চ্যানেল ২৪-এর মাধ্যমে। জাতীয় স্তরে এই চ্যানেলটি তিনি বানিয়েছিলেন বর্তমান ঘটনা আর আলোচনার ওপর জোর দিয়ে। দেশের সেরা উপস্থাপকদের নিয়ে তিনি একটি শক্তিশালী দল গড়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতারা এটিকে গুরুত্ব দেয়নি। শেষ পর্যন্ত তিনি এটিকে সাধারণ সংবাদ চ্যানেলে রূপান্তর করেন, যা এখন অন্য চ্যানেলের মতোই সংগ্রাম করছে।

২০১৯ সালে মিডিয়া শিল্পের সংকট তাঁকে ধাক্কা দেয়। ১,৮০০ কর্মীর এক-তৃতীয়াংশ ছাঁটাই করতে হয়। চ্যানেল ২৪-এর পেশোয়ার ব্যুরো বন্ধ হয়ে ৬০০ জন চাকরি হারান। তিনি হেসে বলেন, “এখন চ্যানেল খুলতে গেলে এক বিলিয়ন রুপি পুড়তে হবে। আমরা ব্রেক ইভেন করতে পারলেই ভাগ্যবান।”

মহসিন নকভী একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি লাহোরের গলি থেকে উঠে এসে একটি সাম্রাজ্য গড়েছেন। সিটি৪২ তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়, কিন্তু চ্যানেল ২৪ কি তাঁর শেষ গান হয়ে উঠবে? শিল্পের এই অন্ধকার সময়ে তিনি টিকে থাকতে পারবেন কি? তাঁর গল্প শুধু সাফল্যের নয়, বেঁচে থাকার লড়াইয়েরও।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net