হামীম কেফায়েত ।।
আজকে ২৩ নভেম্বর, প্রতিদিনকার পৃথিবীতে একটি সাধারণ দিন। কারণে-অকারণে হয়তো অনেকের কাছে বিশেষ, বিশেষভাবে স্মরণীয়— আজকের দিনেই ৫০-এ পা দিয়েছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Sangeeta Bandyopadhyay)। যিনি বাংলা সাহিত্যের এক অগ্রগণ্য ভারতীয় লেখক। সাহিত্যে আধুনিকতা, নারীর স্বাধীনতা এবং সম্পর্কের জটিলতা তুলে ধরেছেন একক সাহসিকতার সঙ্গে। ২৩ নভেম্বর, ১৯৭৪, পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে জন্মগ্রহণকারী সঙ্গীতা ছাত্রাবস্থায় লেখালেখির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে কলকাতায় এসে সাহিত্য জগতে শক্ত পদচিহ্নের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন। সেই আলো ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।
যতটা সাহিত্যিক গুণে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশংসিত, ততটাই তার জীবনদর্শনও প্রশংসনীয়। শিক্ষাজীবনে বাগবাজার মাল্টিপারপাস স্কুল এবং গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস কলেজে পড়াশোনা করেন, ২০০১ সালে তার কবিতা প্রথমবার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর সঙ্গীতার লেখার পথচলা কেবল সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শাহরুখ আর আমি’ আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ‘অনেক অবগাহন’ নামের কাব্যগ্রন্থেও তার সাহিত্যিক দক্ষতা প্রকাশ পায়।
তবে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক যাত্রায় তার উপন্যাসগুলো বিশেষভাবে স্মরণীয়। তার প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খিনী’ ২০০৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ‘দেশ’-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, যা পাঠক মহলে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করে। তবে সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত উপন্যাস ছিল ‘প্যান্টি’, যা সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গিকেও নতুন আলোয় প্রতিষ্ঠিত করেছে। ‘প্যান্টি’ বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে ওঠে এবং এটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বব্যাপী পাঠক মহলে পৌঁছায়।
এখানেই শেষ নয়, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে একটি গভীরতা এবং সত্য প্রকাশের সাহস রয়েছে, যা তাকে অন্য লেখকদের থেকে আলাদা করে। তিনি প্রতিনিয়ত সমাজের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে— নারীর অবস্থান, সম্পর্কের জটিলতা, যৌনতা এবং জীবনের কঠিন বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ‘প্যান্টি’ উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি একটি বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন, যা বাংলা সাহিত্যে খুবই দুর্লভ। তার লেখায় যে সাহস, শক্তি এবং স্রোত রয়েছে, তা একমাত্র একজন বাস্তববাদী লেখকই প্রকাশ করতে পারেন।
শুধু সাহিত্যের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে, সঙ্গীতা নিজের জীবনকেও সাহিত্যের মতোই সমৃদ্ধ করেছেন। লেখক হিসেবে তার যাত্রা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা। তিনি কখনোই নিজেকে শুধু একজন সাহিত্যিক হিসেবে আবদ্ধ রাখেননি, বরং একজন চিন্তাশীল সমাজকর্মী হিসেবেও পরিচিত হয়েছেন। তার লেখার মধ্যে যে গভীরতা ও নিত্য নতুন ভাবনার প্রকাশ রয়েছে, তা তাকে বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ স্থান এনে দিয়েছে।
তার সাহিত্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি কখনোই সাহিত্যের বাইরে যাবেন না— তার লেখা নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা, বিতর্ক ও প্রশংসা— সবই সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার লেখায় কোনো বিষয়ই পেছনে পড়ে থাকেনি, বরং তিনি জীবনের প্রত্যেকটা দিককে খোলাখুলি উপস্থাপন করেছেন, যা তাকে সাহিত্যের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এবং এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন।
আজ সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনে, আমি শুধু তার সাহিত্যিক অবদানকেই স্মরণ করছি না, তার সাহিত্যে থাকা গভীর চিন্তা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাকেও শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সঙ্গীতা, আপনি শুধু একজন লেখক নন, আপনি বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কণ্ঠস্বর এবং একজন পথপ্রদর্শকের মতো ভাস্বর। আপনার লেখা আমাদের মনে শক্তি, সাহস ও গভীর চিন্তার আলো দেয়।
শুভ জন্মদিন, সঙ্গীতা! আপনার সাহিত্যিকযাত্রা অব্যাহত থাকুক, আমাদের কাছে আপনার প্রতিটি লেখা জীবনের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসুক। ১০০তম জন্মদিনের জন্য আগাম শুভেচ্ছা।
লেখক : সম্পাদক, ঢাকাবার্তা
(লেখাটিতে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নশ্বর পায়ার’ শিরোনামের একটি কবিতা নিয়ে আলোচনা ছিলো। পরে জানা যায়, শঙ্খিনীর সঙ্গীতা আর নশ্বর পায়ার-এর সঙ্গীতা এক নয়। তাই কবিতা নিয়ে আলোচনার অংশটি বাদ দেওয়া হলো। —বিভাগীয় সম্পাদক)