রবিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৫

হুসেইন দাউদ : জীবন, ব্যবসায়িক যাত্রা ও সমাজসেবা

by ঢাকাবার্তা
হুসেইন দাউদ

প্রোফাইল ডেস্ক ।। 

১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের বোম্বাইয়ে জন্মগ্রহণকারী হুসেইন দাউদ একটি মেমন পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তার পিতা আহমেদ দাউদ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, যিনি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় পরিবার নিয়ে করাচিতে চলে আসেন। হুসেইন শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধাতুবিদ্যায় স্নাতক এবং নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কেলগ স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এই শিক্ষাগত ভিত্তি তাকে ব্যবসায়িক জগতে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সাহায্য করে।

পাকিস্তানে ফিরে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন এবং দ্রুতই দাউদ গ্রুপের নেতৃত্বে আসেন। তার নেতৃত্বে দাউদ হারকিউলিস কর্পোরেশন, যা পরবর্তীতে এনগ্রো কর্পোরেশনের সঙ্গে একীভূত হয়ে আরও শক্তিশালী হয়, পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপে পরিণত হয়। এনগ্রো কর্পোরেশন বর্তমানে সার, শক্তি, রাসায়নিক, খাদ্য এবং পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে। হুসেইন দাউদের দূরদর্শিতার কারণে এনগ্রো আজ পাকিস্তানের অর্থনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি যৌথ উদ্যোগে (joint ventures) ইউরোপীয়, আমেরিকান, জাপানি এবং চীনা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেছেন, যা তার বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দেয়।

তার ব্যবসায়িক দর্শন ছিল টেকসই উন্নয়ন এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে। তিনি এনগ্রোকে শুধু লাভজনক প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং পরিবেশবান্ধব এবং সমাজকল্যাণমুখী একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন।

হুসেইন দাউদের জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তার সমাজসেবা। তিনি দাউদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং দুর্যোগ ত্রাণে কাজ করে। দাউদ পাবলিক স্কুল, মরিয়ম দাউদ স্কুল অফ ভিজ্যুয়াল আর্টস অ্যান্ড ডিজাইন এবং এনগ্রো ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি হাজারো মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় তিনি এনগ্রো এবং দাউদ হারকিউলিসের পক্ষ থেকে ১ বিলিয়ন রুপির আর্থিক সহায়তা প্রতিশ্রুতি দেন, যা পাকিস্তানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সহায়ক ছিল।

২০২৪ প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারীর কাছ থেকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিলাল-ই-ইমতিয়াজ গ্রহণ করছেন হুসেইন দাউদ।

২০২৪ প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারীর কাছ থেকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিলাল-ই-ইমতিয়াজ গ্রহণ করছেন হুসেইন দাউদ।

তিনি করাচি স্কুল অফ বিজনেস অ্যান্ড লিডারশিপ (KSBL)-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান। এছাড়া তিনি ইসলামাবাদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বীকনহাউস ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। তার এই কাজগুলো শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি তার অঙ্গীকারের প্রতিফলন।

২০২৩ সালের ১৮ জুন হুসেইন দাউদের জীবনে একটি অপূরণীয় ক্ষতির দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তার ছেলে শাহজাদা দাউদ (৪৮) এবং নাতি সুলেমান দাউদ (১৯) টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে ওশানগেট এক্সপিডিশনের টাইটান সাবমার্সিবলে ছিলেন। এই সাবমার্সিবলটি উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে, প্রায় ৩,৮০০ মিটার (১২,৫০০ ফুট) গভীরে যাওয়ার সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

টাইটান সাবমার্সিবলটি ছিল ওশানগেট নামক একটি বেসরকারি কোম্পানির পরিচালিত পর্যটনমূলক অভিযানের অংশ। এটি পাঁচজন যাত্রী নিয়ে ১৮ জুন সকালে যাত্রা শুরু করে। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন শাহজাদা দাউদ, তার ছেলে সুলেমান দাউদ, ওশানগেটের সিইও স্টকটন রাশ, ব্রিটিশ ব্যবসায়ী হামিশ হার্ডিং এবং টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পল-হেনরি নার্জোলেট। সাবমার্সিবলটি তার সারফেস জাহাজ পোলার প্রিন্সের সঙ্গে যোগাযোগ হারায় মাত্র ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল সাবমার্সিবলটি হয়তো সমুদ্রের তলদেশে আটকে গেছে বা এর অক্সিজেন সরবরাহ ফুরিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের সম্মিলিত উদ্ধারকারী দল সমুদ্রের গভীরে এবং আকাশে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করে। প্রায় ৯৬ ঘণ্টা পর, ২২ জুন, মার্কিন কোস্ট গার্ড ঘোষণা করে যে তারা টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে একটি ধ্বংসাবশেষের ক্ষেত্র (debris field) খুঁজে পেয়েছে। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সাবমার্সিবলের টেল কোন এবং প্রেসার হালের অংশ ছিল, যা নির্দেশ করে যে সাবমার্সিবলটি একটি “ক্যাটাস্ট্রফিক ইমপ্লোশন” বা বিস্ফোরণের শিকার হয়েছে। এই ঘটনায় সাবমার্সিবলের সব যাত্রী তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান।

শাহজাদা দাউদ ছিলেন এনগ্রো কর্পোরেশনের ভাইস-চেয়ারম্যান এবং দাউদ গ্রুপের উত্তরাধিকারী। তিনি টাইটানিকের ইতিহাসের প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন এবং এই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন ফাদার্স ডে উপলক্ষে তার ছেলে সুলেমানের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য। সুলেমান, যিনি স্কটল্যান্ডের স্ট্রাথক্লাইড বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষার্থী ছিলেন, এই অভিযানে যাওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে ভীত ছিলেন। তার খালা আজমেহ দাউদের মতে, সুলেমান এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন শুধুমাত্র তার বাবাকে খুশি করতে।

পিতাপুত্র শাহজাদা দাউদ ও সুলেমান দাউদ

পিতাপুত্র শাহজাদা দাউদ ও সুলেমান দাউদ

দুর্ঘটনার পর জানা যায় যে টাইটান সাবমার্সিবলের নিরাপত্তা নিয়ে পূর্বে একাধিক সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে সামুদ্রিক প্রকৌশলীদের একটি দল ওশানগেটকে সাবমার্সিবলের নকশা এবং পরীক্ষার অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সাবমার্সিবলটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা শংসাপত্র ছাড়াই চলছিল, এবং এর নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ, যেমন কার্বন ফাইবার, গভীর সমুদ্রের চাপ সহ্য করার জন্য উপযুক্ত ছিল না বলে সমালোচনা উঠেছিল। এছাড়া, সাবমার্সিবলের অপারেশনে অভিজ্ঞ পাইলটের অভাব এবং সঠিক প্রাক-অভিযান পরীক্ষার অভাবও দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

হুসেইন দাউদ এবং তার স্ত্রী কুলসুম দাউদ এই দুর্ঘটনার পর একটি বিবৃতি জারি করে বলেন, “আমরা গভীর শোকের সঙ্গে আমাদের প্রিয় শাহজাদা এবং সুলেমানের মৃত্যুর খবর জানাচ্ছি। উদ্ধারকারী দলের অক্লান্ত প্রচেষ্টা আমাদের জন্য শক্তির উৎস ছিল।” শাহজাদার স্ত্রী ক্রিস্টিন দাউদ, যিনি পোলার প্রিন্স জাহাজে তার মেয়ে আলিনার সঙ্গে ছিলেন, বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি মনে করি না আমি বা আলিনা কখনো এই ক্ষতি থেকে পুরোপুরি সেরে উঠতে পারব। তবে আমরা শাহজাদার কাজ এবং সুলেমানের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করে যাব।”

এই দুর্ঘটনা পাকিস্তানের জনগণের মধ্যেও গভীর শোকের সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মকর্তা এবং সাধারণ মানুষ শাহজাদা এবং সুলেমানের জন্য শোক প্রকাশ করেন।

হুসেইন দাউদ তার বক্তৃতায় সবসময় টেকসই উন্নয়ন, শিক্ষা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার ওপর জোর দিয়েছেন। তার কিছু উল্লেখযোগ্য উদ্ধৃতি হলো:

  • টেকসই উন্নয়ন নিয়ে: “আমাদের ব্যবসায়ের লক্ষ্য শুধু লাভ নয়, বরং এমন একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা, যেখানে আমাদের সমাজ এবং পরিবেশ একসঙ্গে উন্নতি করবে।”
  • শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে: “শিক্ষা হলো এমন একটি বিনিয়োগ, যার ফল আমরা আজ না দেখলেও, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথ দেখাবে।”
  • সমাজসেবা নিয়ে: “আমাদের সাফল্য তখনই পূর্ণতা পায়, যখন আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য কিছু ফিরিয়ে দিতে পারি।”
  • নেতৃত্ব নিয়ে: “একজন নেতার কাজ হলো এমন একটি দল গড়ে তোলা, যারা একসঙ্গে স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়।”

এই উদ্ধৃতিগুলো তার জীবনদর্শন এবং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির একটি ঝলক দেয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ব্যবসা এবং সমাজ একে অপরের পরিপূরক, এবং একটির উন্নতি অন্যটির ওপর নির্ভর করে।

হুসেইন দাউদ পাকিস্তানের জন্য একটি প্রেরণার উৎস। তার নেতৃত্বে এনগ্রো কর্পোরেশন এবং দাউদ গ্রুপ দেশের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলেছে। তার সমাজসেবা এবং শিক্ষার প্রতি অঙ্গীকার হাজারো মানুষের জীবনে আলো জ্বালিয়েছে। কিন্তু টাইটান দুর্ঘটনা তার জীবনে একটি গভীর ক্ষত রেখে গেছে, যা তাকে ব্যক্তিগতভাবে ভেঙে দিলেও তার কাজের প্রতি তার দৃঢ়তাকে কমাতে পারেনি। তিনি আজও তার দাতব্য কাজ এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে পাকিস্তানের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তার জীবন আমাদের শেখায় যে সাফল্য তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা সমাজের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net