শনিবার, ডিসেম্বর ৬, ২০২৫

মোহাম্মদ লুৎফর রহমান

যশোর থেকে ঢাকায় নতুন জীবনের সন্ধানে আসা এই তরুণ তখনও জানতেন না, দেশের বৃহত্তম ওষুধের চেইন শপ ‘লাজ ফার্মা’ একদিন তাঁর হাত ধরেই জন্ম নেবে।

by ঢাকাবার্তা
লাজফার্মার সামনে প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ লুৎফর রহমান

প্রোফাইল ডেস্ক ।। 

১৯৭২ সালের এক সন্ধ্যায় ঢাকার নিউমার্কেটের ভিড়ভাট্টা ও বাসের চাপের মাঝ দিয়ে সদ্য বিবাহিত মোহাম্মদ লুৎফর রহমান নেমেছিলেন হাতে একটি পুরোনো স্যুটকেস আর পকেটে মাত্র ২৫০ টাকা নিয়ে। যশোর থেকে ঢাকায় নতুন জীবনের সন্ধানে আসা এই তরুণ তখনও জানতেন না, দেশের বৃহত্তম ওষুধের চেইন শপ ‘লাজ ফার্মা’ একদিন তাঁর হাত ধরেই জন্ম নেবে। ঢাকায় আসার পথে অল্প কিছু টাকাও খরচ হয়ে যায়। নতুন শহরে তিনি চাকরি পাবেন কি না—এই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। রাতে থাকার জায়গা না থাকায় দম্পতি মালিবাগে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন।

শিক্ষাজীবনে লুৎফর ছিলেন মেধাবী ছাত্র। তাঁর পাট ব্যবসায়ী বাবা তাঁকে যশোরের সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করান। কিন্তু সময়ের প্রবাহ তাঁকে বামপন্থী রাজনীতিতে নিয়ে যায়। নকশালদের সশস্ত্র সংগঠনে যুক্ত হয়ে পড়েন, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। পরে দলের নেতারা তাঁর বাবাকে ‘বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে বাবাকে হত্যা করার দায়িত্বও চাপিয়ে দেন তাঁর ওপর। কিন্তু লুৎফর তা মানতে পারেননি; বাবাকে হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন এক বাড়িতে। সেখানকার মেয়েকে তিনি পড়াতে শুরু করেন, এবং সেই শিক্ষার্থীই পরবর্তীতে হন তাঁর জীবনসঙ্গিনী। বেকার অবস্থায় বিয়ের পর সংসারের কষ্ট আরও বেড়ে গেলে তারা ঢাকায় নতুন করে ভাগ্য গড়ার সিদ্ধান্ত নেন।

ঢাকায় আসার দ্বিতীয় দিন কলাবাগান এলাকায় এক পুরোনো বন্ধুকে খুঁজে পান লুৎফর। বন্ধু তাঁর জন্য মাসিক ৩০ টাকায় এক রুমের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিছুদিন পর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তাঁকে ডাক্তার রাশেদুল বারীর কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক তখন জানিয়ে দেন, তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, আর ডাক্তার বারী কিছু ওষুধ দিয়ে সহায়তাও করেন। পরে লুৎফরের দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে ডাক্তার বারী তাঁকে নিজের চেম্বারের ফার্মেসিতে চাকরি দেন। তাঁর কাজ ছিল পুরান ঢাকা থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা এবং চেম্বারের ফার্মেসিতে মুনাফায় বিক্রি করা। স্বাধীনতার পর দেশে ওষুধের ঘাটতি, রাতারাতি মূল্যবৃদ্ধি—সবকিছু মিলিয়ে কাজ ছিল কঠিন; কিন্তু লুৎফর ধীরে ধীরে ওষুধ ব্যবসার জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন।

ছয় মাস কাজ করে তিনি ৬,৬০০ টাকা সঞ্চয় করেন এবং ১৯৭২ সালের শেষের দিকে একজন অংশীদারকে নিয়ে কলাবাগানে ‘শতদল’ নামে ফার্মেসি খুলে বসেন। দিনে দোকানে বসে চিকিৎসা–সংক্রান্ত বই পড়তেন। আট মাস পর অংশীদার ব্যবসা ছাড়তে চাইলে তিনি তাঁর প্রাপ্য ফেরত দিয়ে একাই দোকান চালাতে থাকেন। দুই বছর পর ফার্মেসিটি প্রথম গলিতে স্থানান্তর করেন এবং সন্তানের নাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন নাম দেন ‘লাজ ফার্মা’—মেয়ে লাইজুর ‘লা’ এবং ছেলে জয়ের ‘জ’ দিয়ে।

চার বছর পর, ১৯৭৮ সালে দোকানটি মিরপুর রোডে স্থানান্তর করলে তাঁর জীবনে আসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। একদিন এক গ্রাহক ওষুধ কিনতে এসে পরিচয় দেন—সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুৎফর রহমান সরকার। বহুদিন ধরে যাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন লুৎফর, ভাগ্যের পরিহাসে সেই মানুষই সেদিন তাঁর দোকানে এসে দাঁড়ান। কিছু কথাবার্তার পর তিনি লুৎফরকে ব্যাংকের ওষুধ সরবরাহের সুযোগ দেন এবং একই দিনের সন্ধ্যায় প্রথম চালান চান। চোখের পলকে খুলে যায় লুৎফরের ব্যবসার নতুন দুয়ার। পরে ওই ব্যাংকের সহায়তায় তিনি আড়াই লাখ টাকা ঋণও পান।

ব্যবসা বাড়তে থাকলেও লুৎফর লক্ষ্য করেন, দেশে প্রচুর নকল বা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে—যা তাঁর বাবা দীর্ঘদিন ধরে অজান্তে সেবন করেছেন। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কোনোদিন নকল ওষুধ বিক্রি করবেন না। সত্যনিষ্ঠা ও সততার এই প্রতিশ্রুতিই লাজ ফার্মার ভিত্তিকে শক্ত করে। পরবর্তীতে ১৯৯০–এর দশকে ওষুধ ব্যবসায় অনৈতিক প্রতিযোগিতা ও বিশৃঙ্খলায় হতাশ হয়ে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ১৯৯২ সালে সপরিবারে কানাডা চলে যান এবং সেখানে ঘুরে ঘুরে কানাডার বৃহত্তম ওষুধের খুচরা চেইন ‘ড্রাগ মার্ট’ দেখে মুগ্ধ হন। দোকানের সাজসজ্জা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, গ্রাহকসেবা—সবকিছু তাঁকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। ১০ বছর কানাডায় থাকার পর ২০০২ সালে দেশে ফিরে লাজ ফার্মাকে আধুনিক রূপ দেন।

লুৎফর মনে করতেন, মানসম্মত ফার্মেসি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হলে অন্যদেরও সুযোগ দিতে হবে। তাই নির্দিষ্ট মানদণ্ডে, সেবা–মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিদের লাজ ফার্মার ব্র্যান্ড নাম ও লোগো ব্যবহারের অনুমতি দিতে শুরু করেন। এককালীন ৫ লাখ টাকা দিয়ে বিভিন্ন মালিক তাঁর ফ্র্যাঞ্চাইজি পেতে থাকেন। বর্তমানে লাজ ফার্মার নিজের চারটি শাখাসহ সারা শহরে প্রায় ৬৫টি ফ্র্যাঞ্চাইজি দোকান রয়েছে—মোট ৬৯টি ফার্মেসি, যেখানে লুৎফরের অংশীদারিত্ব রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ লাজ ফার্মার সেবা নেন, এবং দৈনিক লেনদেন প্রায় ১ কোটি টাকার মতো।

তিনি বিশ্বাস করেন, ওষুধ ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে রাখলে কার্যকারিতা নষ্ট হয়—তাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকান ছাড়া মানসম্মত সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। ফার্মেসির সঠিক তাপমাত্রা নিয়ে ছোট পুস্তিকা লেখার পাশাপাশি তিনি সময় পেলে উপন্যাসও লেখেন। এখন আত্মজীবনী লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

২০২০ সালে র‍্যাব কলাবাগান শাখায় কিছু মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পাওয়া গেলে প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করা হয়, যা লুৎফর হতাশার সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছিলেন—সেসব ছিল বিক্রির জন্য নয়, আলাদা করে রাখা কার্টনের মধ্যে সংরক্ষিত। আরেকবার কাকরাইল–এর একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে অনিবন্ধিত ওষুধ পাওয়া গেলে কিছু সময় ফ্র্যাঞ্চাইজি স্থগিত রাখা হয়। ঘটনাগুলো দুঃখজনক হলেও তিনি মনে করেন, এগুলো ব্যবসার মূল ভাবমূর্তিকে নষ্ট করতে পারেনি।

আজ ৭২ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে লুৎফরের লক্ষ্য খুবই পরিষ্কার—সারা দেশে মডেল ফার্মেসি ধারণাকে বিস্তৃত করা, যেন মানুষ নিরাপদ ও মানসম্মত ওষুধ পায়। মজার বিষয় হলো, তিনি নিজে বাংলাদেশি ওষুধ সেবন করেন না; কানাডার নাগরিক হিসেবে সেখানে বছরে যে বিনামূল্যে ওষুধ পান, সেটিই সারা বছর ব্যবহার করেন।

একটি স্যুটকেস, ২৫০ টাকা, একরাশ অনিশ্চয়তা—সেই বিন্দু থেকে শুরু করে দেশের ওষুধখাতের অন্যতম বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড দাঁড় করানোর গল্পটি আসলে দৃঢ়তা, নৈতিকতা ও নিরলস পরিশ্রমেরই গল্প। মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের জীবনী তাই বাংলার স্বপ্নবাজ মানুষের এক শক্তিশালী অনুপ্রেরণা।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net