ডেস্ক রিপোর্ট ।।
পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তান গত ২৪ এপ্রিল থেকে ভারতীয় বিমানের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোর উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, যার ফলে ফ্লাইটের সময়, খরচ এবং টিকিটের দাম বেড়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো, স্পাইসজেট এবং এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের মতো সংস্থাগুলো এখন গভীর সংকটের মুখে।
কোন বিমান সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত?
পাকিস্তানের নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় মালিকানাধীন সকল বিমান সংস্থার উপর প্রযোজ্য। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে:
- এয়ার ইন্ডিয়া: ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আমেরিকাগামী ফ্লাইটগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
- ইন্ডিগো: দিল্লি-বাকু রুটে সময় ও খরচ বেড়েছে।
- স্পাইসজেট এবং এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস: তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতি হলেও তাদের মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটগুলো প্রভাবিত।
প্রতিদিন প্রায় ২০০-৩০০ ভারতীয় ফ্লাইট পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করত। নিষেধাজ্ঞার ফলে এই ফ্লাইটগুলোকে এখন বিকল্প রুট ব্যবহার করতে হচ্ছে।
বিকল্প রুট: কোন দেশের আকাশসীমা ব্যবহৃত হচ্ছে?
পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ হওয়ায় ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো নিম্নলিখিত দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করছে:
- ইরান: দিল্লি থেকে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটগুলো আরব সাগর হয়ে ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার করছে।
- ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত: মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটগুলো এই রুট ব্যবহার করছে।
- আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া: কিছু ফ্লাইট তুর্কমেনিস্তান বা উজবেকিস্তানের আকাশসীমা দিয়ে যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ইন্ডিগোর দিল্লি-বাকু ফ্লাইট এখন গুজরাটের উপর দিয়ে আরব সাগর হয়ে ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার করছে।
অতিরিক্ত খরচ ও সময়ের প্রভাব
নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতীয় বিমান শিল্প প্রতিদিন লাখ লাখ ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার দাবি, এই নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় এয়ারলাইন্সের জন্য “বিশাল আর্থিক ধাক্কা”। প্রধান ক্ষতিগুলো হলো:
জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি:
- বিকল্প রুটগুলো দীর্ঘ হওয়ায় জ্বালানি খরচ ৩০-৪০% বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লি-মধ্যপ্রাচ্য ফ্লাইটে প্রতি ফ্লাইটে হাজার হাজার ডলার অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।
- টরন্টো-দিল্লি রুটে এয়ার ইন্ডিয়াকে কোপেনহেগেনে থামতে হচ্ছে জ্বালানি নেওয়ার জন্য, যা খরচ আরও বাড়িয়েছে।
টিকিটের দাম বৃদ্ধি:
- বিমান ভাড়া ৮-১২% বেড়েছে। যাত্রীদের এখন ইউরোপ বা আমেরিকাগামী ফ্লাইটে বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে।
- দীর্ঘমেয়াদে নিষেধাজ্ঞা চলতে থাকলে ভাড়া আরও বাড়তে পারে।
ফ্লাইট সময় বৃদ্ধি:
- দিল্লি-বাকু ফ্লাইটে এখন ৫ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট লাগছে, আগে যা ছিল ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট।
- দিল্লি-মধ্যপ্রাচ্য ফ্লাইটে ১ ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে।
- টরন্টো-দিল্লি ফ্লাইটে ২-৩ ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে, কিছু ক্ষেত্রে ৫-৭ ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়ছে।
অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ:
- মাঝপথে জ্বালানি নেওয়ার জন্য আবু ধাবি বা আহমেদাবাদে থামতে হচ্ছে, যা খরচ ও সময় বাড়াচ্ছে।
- কার্গো বহন কমাতে হচ্ছে, যা আয় হ্রাস করছে।
যাত্রীদের উপর প্রভাব
যাত্রীরা এখন দীর্ঘ ফ্লাইট সময় এবং ব্যয়বহুল টিকিটের চাপে পড়েছেন। এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিগো ফ্লেক্সিবল রিবুকিং ও রিফান্ড নীতি চালু করেছে, তবে এটি যাত্রীদের অসুবিধা পুরোপুরি কমাতে পারছে না। একজন যাত্রী বলেন, “দিল্লি থেকে লন্ডনের টিকিট এখন প্রায় ১০,০০০ টাকা বেশি, আর ফ্লাইটে দুই ঘণ্টা বেশি সময় লাগছে।”
কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব
পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান সিন্ধু নদী চুক্তি স্থগিত এবং শিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি দিয়েছে। এছাড়া, বাণিজ্য ও পর্যটন খাতেও প্রভাব পড়ছে। ভারতীয় পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েছে, যা রপ্তানি বাণিজ্যের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। পর্যটকরা ভারতের পরিবর্তে অন্য গন্তব্য বেছে নিতে পারেন, যা পর্যটন শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি
পাকিস্তান জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা প্রাথমিকভাবে ২৩ মে, ২০২৫ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। তবে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি অব্যাহত থাকলে এটি দীর্ঘায়িত হতে পারে। ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো বিকল্প রুটে সমন্বয় করছে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই ক্ষতি তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইন্সগুলো তুলনামূলকভাবে কম খরচে একই গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে, যা ভারতীয় সংস্থাগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ।
উপসংহার
পাকিস্তানের আকাশসীমা নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় বিমান শিল্পের জন্য একটি বড় ধাক্কা। জ্বালানি খরচ, টিকিটের দাম এবং ফ্লাইট সময় বৃদ্ধির ফলে যাত্রী ও এয়ারলাইন্স উভয়ই চাপে পড়েছে। এই পরিস্থিতি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করছে। বিমান সংস্থাগুলো যদিও বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছে, তবে এই সংকট দীর্ঘায়িত হলে ভারতীয় বিমান শিল্পের ক্ষতি আরও বাড়তে পারে।