স্টাফ রিপোর্টার ।।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-তে যাত্রার শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন, অথচ আজ তিনি সেই পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। সাধারণ আলেম সমাজের আহ্বায়ক মুহাম্মদ রিদওয়ান হাসান তাঁর পদত্যাগপত্রে শুধু একটি দলে ‘পদ হারানো’র কথা বলেননি, বরং গভীরভাবে প্রশ্ন তুলেছেন—দলের আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধগত অবস্থান নিয়ে, বিশেষত ইসলামপন্থী আলেমদের প্রতি এনসিপির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
চব্বিশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ৮০ জনের বেশি আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক নবজাগরণ সূচিত হয়েছিল, রিদওয়ান হাসান মনে করেন তিনি ছিলেন তারই সহযাত্রী। তিনি বলেন, “এই ইতিহাসের অংশ হতে পেরে আমি গর্বিত।”
রিদওয়ান হাসান এক ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেছেন, পার্টিতে আলেমদের রাখার প্রবণতা ছিল প্রতীকি এবং সাংগঠনিকভাবে অস্পষ্ট। “যদি মনে করেন, আলেমরা দরবারি হবে, এজন্য তাদের রাখছেন, তাহলে এটা সঠিক এপ্রোচ না,”—এই বাক্যটি শুধু হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি সতর্কবার্তা।

সাধারণ আলেম সমাজের উদ্যোগে আয়োজিত ‘আমারও কিছু বলার আছে’ শীর্ষক সমাবেশে কথা বলছেন রিদওয়ান হাসান। ২০২৪-এর ৩ জুলাই তোলা ছবি।
তিনি আরও বলেন, “যদি তাদেরকে দরকারি মনে করেন, তাহলে কোন জায়গায় কেন দরকার, তা নির্ধারণ করতে হবে।”
পোস্টে তিনি উল্লেখ করেছেন, এনসিপির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার পরও তিনি পার্টির কোনো অর্গানোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। দলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই পরে তাঁকে চেনেন না বলেও ইঙ্গিত করেন। ইফতার মাহফিল, ঈদের দিন যাত্রাবাড়ী সফর, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সভার মতো ঘটনাগুলোতেও তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এসব ঘটনায় তিনি একজন সাধারণ কর্মীর মতো অনুভব করেছেন নিজেকে।
তিনি বলেন, “আমি তৃতীয় সাধারণ সভায় এসেছিলাম মূলত পদত্যাগ করার জন্য। কিন্তু সেদিন সদস্যদের খোলামেলা আলোচনায় কিছুটা আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিছুদিন অপেক্ষা করবো।” কিন্তু সে আশাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
রিদওয়ান হাসান লিখেছেন, “আমি গণতন্ত্র মানি না— এমন না বিষয়টা। আমি গণতন্ত্র মানি।” তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, যদি গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়, তাহলে খিলাফাহ বা মুসলিম কনফেডারেশনের মতো একটি ব্যবস্থা তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য বিকল্প হতে পারে। তাঁর এই অবস্থান তাঁকে একটি গঠনমূলক আলাপের প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যায়— যেখানে তিনি পশ্চিমা উদ্ভূত ‘নিরঙ্কুশ’ গণতন্ত্র নয়, বরং প্রাসঙ্গিক এবং মূল্যবোধভিত্তিক গণতন্ত্রকে মানেন।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রেও গণতন্ত্রকে সেভাবেই মেনে নিয়েছি যেমন মোবাইল অ্যাপসে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন মেনে নিতে হয়।”
রিদওয়ান হাসান এনসিপির ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, সাংগঠনিক কাঠামো যদি আন্তরিকভাবে সকল মত ও বিশ্বাসকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে দলটি ভবিষ্যতে সংকটের মুখে পড়বে। “ইন্টারপার্টি নানান বিষয় নিয়ে অভিমান ও তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, যা দীর্ঘমেয়াদে এনসিপির সাথে আমার পথচলাকে সংকুচিত করত।”
পোস্টের শেষাংশে রিদওয়ান হাসান শুভকামনা জানিয়েছেন এনসিপির জন্য। “ভবিষ্যতে জাতীয় নাগরিক পার্টির কল্যাণ ও সাফল্য কামনা করছি,”—বললেও, তাঁর কণ্ঠে স্পষ্টতই বিদায়ের সুর। তিনি দলে না থেকেও দেশের কল্যাণে যে কোনো ইতিবাচক উদ্যোগে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।
রিদওয়ান হাসানের পদত্যাগ কেবল একটি দল থেকে সরে যাওয়ার ঘটনা নয়, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একটি সতর্কবার্তা—প্রতীকি অন্তর্ভুক্তি নয়, কার্যকর ও মর্যাদাপূর্ণ অংশগ্রহণই দলকে শক্তিশালী করে। বিশেষত যারা একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের উত্তরাধিকার দাবি করে, তাদের জন্য এই বার্তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ।
এই পোস্ট ও অবস্থান কেবল এনসিপির অভ্যন্তরীণ সংকটই উন্মোচন করেনি, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামপন্থীদের অবস্থান, মর্যাদা এবং প্রতিনিধিত্ব নিয়েও নতুন আলোচনা তৈরি করেছে।