শুক্রবার, জানুয়ারি ১৭, ২০২৫

গুজরাট দাঙ্গার মুখ : এক ছবি, দুই জীবন

by ঢাকাবার্তা
বামে কুতুবউদ্দিন আনসারি, অর্ক দত্তের তোলা ছবি।

সৌতিক বিশ্বাস, বিবিসি ।। 

২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার নির্মমতার এক প্রতীক হয়ে উঠেছিল একটি ছবি। ওই ছবিটি তুলেছিলেন অর্ক দত্ত, যা বিশ্বব্যাপী “গুজরাট দাঙ্গার মুখ” হিসেবে পরিচিতি পায়। ছবির মূল চরিত্র ছিলেন কুতুবউদ্দিন আনসারি, যিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত মুখে হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। ১০ বছর পর, আলোকচিত্রী অর্ক দত্ত এবং কুতুবউদ্দিন আনসারি একে অপরের সঙ্গে পুনরায় দেখা করেন। এই পুনর্মিলনের মুহূর্তটি স্মৃতি ও অনুভূতির এক গভীর মিশ্রণ তৈরি করে।


ছবির পটভূমি

১ মার্চ ২০০২, গুজরাটের আহমেদাবাদ শহর। দাঙ্গার দ্বিতীয় দিন। মুসলিম পাড়া থেকে ধোঁয়া উঠছে, বাড়িঘর জ্বলছে। চারপাশে হিন্দু উন্মত্ত জনতা। এ সময় একটি বাড়ির প্রথম তলার বারান্দায় আটকা পড়েছিলেন কুতুবউদ্দিন আনসারি। তার পরনে ছিল হালকা চেক শার্ট, যা রক্তে ভেজা। তার চোখে ভয়ের ছাপ এবং মুখে অসহায়তার চিত্র। জনতার ভিড়ে ঘেরা এই মানুষটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাছে সাহায্যের জন্য হাতজোড় করে প্রার্থনা করেন।

রয়টার্সের আলোকচিত্রী অর্ক দত্ত ওই সময় দাঙ্গা কাভার করছিলেন। অন্ধকার আকাশে ধোঁয়া এবং জ্বলন্ত ভবনের মাঝে তিনি আনসারির অসহায় অবস্থাটি লক্ষ্য করেন। টেলিফটো লেন্সে ফোকাস করে কয়েক সেকেন্ডে তিন থেকে চারটি ছবি তোলেন। এর পর, অর্ক সেনাদের অনুরোধ করেন ভবনটির কাছে থামতে এবং trapped মুসলিমদের উদ্ধার করতে।

পরদিন ছবিটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হয় এবং দ্রুতই “গুজরাট দাঙ্গার প্রতীক” হয়ে ওঠে। ছবিটির ক্যাপশন ছিল: “আহমেদাবাদের একটি বারান্দায় আটকে থাকা এক মুসলিম ব্যক্তি হিন্দু জনতার মাঝে প্রাণভিক্ষা চাইছেন।”


ছবির প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব

ছবিটি যেমন বিশ্বব্যাপী গুজরাট দাঙ্গার নির্মমতা তুলে ধরেছিল, তেমনি আনসারির জীবনে এটি এক অদ্ভুত মোড় আনে। এক সপ্তাহ পর, একটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিক দাঙ্গা-পরবর্তী শরণার্থী শিবিরে আনসারিকে খুঁজে বের করেন এবং তাকে প্রথমবারের মতো এই ছবি দেখান।

ছবির কারণে আনসারি পরিচিতি পান, কিন্তু সেই পরিচিতি তার জন্য একের পর এক সমস্যা নিয়ে আসে। পরিচিতি এবং মিডিয়ার অতিরিক্ত নজরদারির কারণে তিনি একাধিক চাকরি হারান। মালেগাঁও, কলকাতা, এমনকি নিজের শহর আহমেদাবাদেও তাকে বারবার স্থানান্তরিত হতে হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং মুসলিম সংগঠন ছবিটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। এমনকি ভারতজুড়ে বোমা হামলায় অভিযুক্ত একটি গোষ্ঠী এই ছবিটি ব্যবহার করে তাদের দাবি প্রচারে।

আনসারি বলেছিলেন, “এই ছবিটি আমাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আমি প্রতিবার একটি নতুন চাকরি পেয়েছি, কিন্তু মানুষ যখন আমাকে চিনতে পারত, তখন চাকরি হারাতে বাধ্য হতাম।”


দুই জীবনের গল্প

১০ বছর পর, ২০১২ সালে, অর্ক দত্ত এবং কুতুবউদ্দিন আনসারি আহমেদাবাদের সেই বারান্দার নিচে পুনর্মিলিত হন। আনসারি তখন তার জীবন কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছেন। তার একটি ছোট দর্জির দোকান এবং একটি দুই রুমের ছোট বাড়ি আছে, যা তিনি সঞ্চয় ও বন্ধুদের ঋণে কিনেছেন। তার তিন সন্তান, একটি ছোট tailoring ব্যবসা, এবং মাসিক ৭,০০০ রুপি আয়ের মধ্যে তিনি একটি শান্ত জীবনের চেষ্টা করছেন।

অন্যদিকে, অর্ক দত্ত রয়টার্স ছাড়ার পর মুম্বাইয়ে একটি ফটোগ্রাফি স্কুল খুলেছেন। তিনি দাঙ্গা কাভার করার সময় তার মায়ের মৃত্যুর কথা শেয়ার করেন। অর্ক বলেছিলেন, “যখন আমি দাঙ্গার ছবি তুলছিলাম, আমার মা ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে ছিলেন। কিন্তু আমি তার শেষ কথাগুলো শুনতে পারিনি। তিনি মারা যান, যখন আমি দাঙ্গার ছবি তুলছিলাম।”

২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তোলা। গুজরাট দাঙ্গায় একজন ভারতীয় বজরং দল কর্মী লোহার রড হাতে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। ছবি, সেবাস্টিয়ান ডি’সুজা

২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তোলা। গুজরাট দাঙ্গায় একজন ভারতীয় বজরং দল কর্মী লোহার রড হাতে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। ছবি, সেবাস্টিয়ান ডি’সুজা


পুনর্মিলন এবং ক্ষমার বার্তা

পুনর্মিলনের সময়, অর্জুন আনসারিকে বলেন, “আমি দুঃখিত। আমার ছবি আপনাকে অনেক সমস্যার মুখে ফেলেছে। আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি।”

উত্তরে আনসারি বলেন, “আপনি আপনার কাজ করেছেন, আর আমি আমার জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। আপনার ছবি দেখিয়েছে কী ভয়াবহ কিছু ঘটেছিল। এটি আমার নিয়তি ছিল। তবে আজ আমি সুখী। আমার একটি সুন্দর পরিবার আছে, কাজ আছে। এখন জীবন সুন্দর।”

দুইজনের এই পুনর্মিলন তাদের জীবনের ব্যথা, আশা এবং বন্ধুত্বের একটি নতুন অধ্যায় তৈরি করে। অর্ক বলেন, “আমি আনসারিকে তার বর্তমান রূপে মনে রাখতে চাই—একজন সুখী এবং হাসিখুশি মানুষ। তাকে আর ভীত সেই মানুষ হিসেবে দেখতে চাই না।”


শেষ কথা

এই গল্পটি কেবল একটি ছবি বা একটি দাঙ্গার গল্প নয়, এটি দুটি মানুষের জীবনের এমন অধ্যায়, যেখানে একজন অসহায় মানুষ বাঁচার জন্য লড়াই করেছেন এবং একজন আলোকচিত্রী নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে সেই কাজ তাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দাঙ্গার নির্মমতা কেবল একটি সময়কে নয়, জীবনকেও গভীরভাবে আঘাত করে।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net