স্টাফ রিপোর্টার ।।
ঢাকার অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি প্রায় ভেঙে পড়েছে গত বছরের শাসন পরিবর্তনের পর। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ক্রেতারা দেশ ছেড়েছেন বা কারাগারে গেছেন—ফলে বহু উচ্চমূল্যের ইউনিট বাতিল বা ফেরত দিতে হয়েছে। ডেভেলপাররা বলছেন, এখন অনেকগুলো ফ্ল্যাট ফের বিক্রি করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। খবর, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের।
বারিধারার ডিপ্লোম্যাটিক জোনের রোড ৭-এ ছয় কাঠার ওপর একটি ছয়তলা প্রকল্পের উদাহরণ দেওয়া যায়। ২০২৩ সালের শেষদিকে শুরু হওয়া প্রকল্পটির একটি ফ্ল্যাট গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ১৭ কোটি টাকায় বুক করেছিলেন কক্সবাজারের একজন সাবেক এমপি। ছয় কিস্তি দেওয়ার পর তিনি গা ঢাকা দেন এবং নভেম্বরেই ডেভেলপারকে জানিয়ে দেন, তিনি আর ফ্ল্যাটটি নিতে চান না এবং টাকা ফেরত চান। পরে তিনি গ্রেপ্তার হন। একই প্রকল্পের ছয় ইউনিটের মধ্যে তিনটি বুক করেছিলেন আরও দুই সাবেক এমপি ও একজন হুইপ—তাঁরাও একই পথে হাঁটেন।

এই প্রকল্পে প্রতিটি ফ্ল্যাটে ছিল দুটি পার্কিং, সুইজারল্যান্ড থেকে আমদানি করা স্বয়ংক্রিয় ছাতা, ইতালিয়ান মার্বেল, ওক কাঠের জানালা ও দরজা, ছাদে সুইমিং পুলসহ বিলাসী সব সুযোগ-সুবিধা।
- ক্ষমতার পালাবদলের পর বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি ভেঙে পড়েছে
- রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত ক্রেতারা দেশ ছেড়েছেন বা গ্রেপ্তার হয়েছেন
- ডজন খানেক হাইভ্যালু ইউনিট বিক্রির অযোগ্য বা ফেরত দেওয়া হয়েছে
- ২০২৪ সালের আগস্টের পর গুলশান-বনানীসহ অভিজাত এলাকায় বিক্রি প্রায় বন্ধ
- মিড-রেঞ্জ এবং সাধারণ ইউনিটেও স্থবিরতা; পুরো খাতই চাপে
- নতুন প্রকল্প স্থগিত করেছে ডেভেলপাররা, দ্রুত নীতিগত সহায়তা চাইছে
- নগদহীনতা, অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ এবং অব্যবহৃত অর্থ প্রবাহের অভাব প্রধান কারণ
এই সংকট শুধু একটি প্রকল্পে নয়। গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, নিকেতন ও ধানমন্ডির বিভিন্ন বিলাসবহুল প্রকল্পে একই অবস্থা। গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার অফিস জানাচ্ছে, জানুয়ারি থেকে জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত ৭২৮টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নিবন্ধন হয়েছিল, যার মোট মূল্য ছিল প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ আগস্ট ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ৩৯টি।
২০২৩ সালে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে মোট লেনদেন হয়েছিল ২১ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের ১৯ হাজার কোটি টাকার চেয়ে বেশি। তবে চলতি বছর প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে গেছে।
ডেভেলপারদের মতে, রাজনীতিক ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা আগে এই বাজারের প্রধান ক্রেতা ছিলেন। শাসন পরিবর্তনের পর অনেকেই আত্মগোপনে আছেন বা তাঁদের ব্যাংক হিসাব জব্দ হয়েছে। ফলে তাঁরা কিস্তি বন্ধ করে বুকিং বাতিল করেছেন।
শুধু বিলাসবহুল নয়, সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টেও বিক্রি কমে গেছে। রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, ঢাকায় ১০০টিরও বেশি বিলাসবহুল ও ২,০০০-এর বেশি সাধারণ ফ্ল্যাট এখনো বিক্রি হয়নি। অনেক ডেভেলপার নতুন প্রকল্প স্থগিত করেছেন।
বসুন্ধরার ব্লক ‘ই’ তে পাঁচ কাঠার ওপর একটি ছয়তলা বাড়ি ৭.৫ কোটি টাকায় কিনতে চুক্তি করেছিলেন সাবেক এমপি বেনজীর আহমেদ। ৫০ লাখ অগ্রিম দেওয়ার পর আগস্টে তিনি জানিয়ে দেন, তিনি আর কিনবেন না এবং ৯০% টাকা ফেরত চান। বিক্রেতারা এখন ওই বাড়ি ৭ কোটি টাকায় বিক্রির চেষ্টা করছেন।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছে পোস্টোগোলার রিভারভিউ প্রকল্পে। ৫ আগস্টের পর এক আওয়ামী লীগ নেতা চুক্তি করেও উধাও হয়ে যান। দলিল সম্পন্ন হওয়ায় এখন বিক্রি বাতিল বা পুনঃবিক্রি সম্ভব নয়।
এমতাবস্থায় ডেভেলপাররা সরকারের কাছে নীতিগত সহায়তা চেয়েছেন। রিহ্যাবের সাবেক পরিচালক নাঈমুল হাসান বলেন, “অপ্রদর্শিত অর্থ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজারে বিনিয়োগ নেই। কর সুবিধা ও বিশেষ প্রণোদনা না দিলে এই খাত চরম বিপর্যয়ে পড়বে।”
তবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, “যিনি বৈধভাবে আয় করে বিনিয়োগ করছেন, তাঁকে সরকার স্বাগত জানাবে। কিন্তু এর বাইরে সরকারের কিছু করার নেই।”