স্টাফ রিপোর্টার ।।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ৬ সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হারুন-অর-রশিদ ওরফে ডিবি হারুনকে ঘিরে নানা তথ্য ছড়াতে থাকে। যার মধ্যে বিমানবন্দরে হারুনের ওপর হামলা, সিএমএইচে ভর্তি, অন্য বাহিনীর হেফাজতে থাকা, আর সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া। তবে নানা তথ্যের মাঝেও এখনো অজানা হারুনের অবস্থান। অজ্ঞাত স্থান থেকেই সম্প্রতি প্রবাসী সাংবাদিক নাজমুস সাকিবের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে অডিও কলে কথা বলেছেন পুলিশের সাবেক এই প্রভাবশালী কর্মকর্তা।
গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কারীকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে হেফাজতে তুলে নিয়ে নির্যাতনের জেরে শেষবারের মতো আলোচনায় আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। পরে সমন্বয়কদের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার ছবি এবং তাদের দিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি দেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করেন তিনি।
তার এই কর্মকাণ্ডকে জাতির সাথে মশকরা বলেও মন্তব্য করেন উচ্চ আদালত। হাইকোর্টের এমন মন্তব্যের পরও ওই ছয় সমন্বয়কারীকে বেআইনিভাবে আটকে রাখা হয় প্রায় এক সপ্তাহ। এর মাঝে তার একটি আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
পরে ১ আগস্ট তাকে গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস শাখায় পদায়ন করা হয়। নতুন অফিসে সবশেষ ২ আগস্ট দায়িত্ব পালন করেছিলেন হারুন। এরপর থেকেই তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
২০১১ সালের জুলাইয়ে জাতীয় সংসদের সামনে এক মিছিলে তৎকালীন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুককে মারধর করে প্রথম আলোচনায় আসা হারুন এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। গোয়েন্দা পুলিশের মানুষকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভাত খাইয়ে ভিডিও ছেড়ে দেয়া, বিরোধী দলের প্রতিটি আন্দোলনে বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে ‘বোমা ও বাঁশের লাঠিসোটা’ উদ্ধার, প্রতিদিনই সাংবাদিকদের একাধিকবার ব্রিফিং করা, তারকাদের সাথে ফটোসেশন, যাকে তাকে ডিবিতে তুলে নিয়ে আসা, হেফাজতে নির্যাতন, আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়–এমন নানান নেতিবাচক কাজে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত এই কর্মকর্তা।
একটি সূত্র দাবি করছে, সমালোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তা এখন রাজধানীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে পলাতক আছেন পুলিশের অন্তত ৫৭ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এর মধ্যে আছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়ন্দা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদও।
পুলিশের এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে তাকে নিয়েই জনমনে এখন প্রবল জিজ্ঞাসা, কোথায় আছেন এই ডিবির হারুন। তার পরিবারের সদস্য, পুলিশের সহকর্মী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যাচ্ছে, তিনি নিজের বাসা এমনকি আত্মীয়স্বজন কারো বাসাতেই থাকছেন না। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে আরেকটি সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ডিবির এই কর্মকর্তা ৬ আগস্ট গণপিটুনির শিকার হয়ে রাজধানীর একটি বিশেষায়িত হাসপাতানে চিকিৎসাধীন। তার একজন আত্মীয় টিবিএসকে বলেছেন, তিনি এতোটাই ‘জনপ্রিয়’ হয়ে গেলেন যে এখন প্রকাশ্যে আসতেও ভয় পাচ্ছেন।
যা যা বললেন হারুন
বর্তমান অবস্থান ও কাজে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, আমাকে ঘিরে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছিলো। তখনও আমি চুপ ছিলাম। সরকার যখন বললো সবাইকে কাজে যোগ দিতে। তখন আমি গত ৮ আগস্ট ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে তখনই যোগ দিতে নিষেধ করেন। আমাকে নিরাপদ স্থানে থাকতে বলেন। আমি যোগদান করতে গেছি। কিন্তু আমি যোগ দিতে পারি নাই। দুই দিন পর দেখি আমার নামে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা হয়েছে। যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, কমিশনার ও আমাকে হুকুমের আসামি করা হয়। তখন আমি অবাক হলাম। আমি তো ডিবিতে কাজ করি। ডিবির কাজ হলো মামলা তদন্ত করা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশ দিলে আমরা গ্রেফতার করি। মোহাম্মদপুরে তো আমি গিয়ে মারামারি করিনি, এটা তো আমার কাজ না। অতিরিক্ত কমিশনার কি মারামারি করতে যায়। আর ডিএমপিতে কমিশনারের পরে ৬ জন অতিরিক্ত কমিশনার। আমি হলাম ৬ নম্বর কমিশনার। সেখানে আমার নামে যখন মামলা হলো তখন তো একটু আবার বলা হলো মামলা হলেও সমস্যা নেই। ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকলে গ্রেফতার করা হবে না। আমি মনে করলাম ভালো কথা। ভাবলাম জয়েন করবো। পরের দিন দেখলাম একজন উপদেষ্টা বললেন, যেসব পুলিশ কর্মকর্তারা জয়েন করে নাই। তাদের আপনারা ধরে নিয়ে আসেন। আমি তখন আরও অবাক হলাম। আমি চাকরিতে জয়েন না করি তাহলে প্রসিডিং করবে। আর যোগ দিলে আমাকে দিয়ে জোর করে চাকরি করাবেন। এটা শোনার পরে আমার মনে হলো রিস্ক। মানে আমার লাইফ ঝুঁকির মধ্যে। এখন মানুষকে ধরে যেভাবে পেটানো, ডিম মারা হচ্ছে, যদি আমাকে। আগে তো বাঁচতে হবে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে একটু চুপ আছি।
ছাত্রজনতার হাতে গণধোলাইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন বলেন, ফেসবুক, ইউটিউবে নানা গুজব আছে। আপনারা মরার ছবিসহ নানা গুজব দেখেছেন। আমি এগুলো নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। যারা এগুলো বলে তারা টাকা পয়সা পাওয়ার জন্য সামাজিক মাধ্যমে ছাড়ে। এগুলো গুজব।
পুলিশ সদর দফতরের দেওয়াল টপকে পালাতে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার বিষয়ে সাবেক ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, আমি পুলিশ সদর দফতরে যায়নি।
তিনি বলেন, আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকা এসেছিলাম ছুটি নিয়ে। জুলাইয়ের ১৫ তারিখ দেশে ফিরি। দেশে যাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোর কমিটির বাসায় একটা মিটিং হয়। প্রতিদিন সেই মিটিং হতো। মিটিংয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, এনএসআই, ডিজিএফআই, এসবি, বিজিবি প্রধান ছিল। এছাড়াও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ও এনটিএমসির প্রধান। প্রতিদিন কোর কমিটির মিটিং হচ্ছিল। একদিন মিটিংয়ে আমাকে ডাকা হলো। আমার কাছে গ্রেফতারের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়। তখন আমি বলি আমার কাছে কেউ গ্রেফতার নেই। তবে র্যাব নুরুকে গ্রেফতার করে আমার কাছে দিয়েছে, নজরুল ইসলাম খানকে দিয়েছে। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে তিনজন সমন্বয়ক আছে। তাদেরকে এসবি পাহারা দিচ্ছিলো। আমাকে বলা হলো- তাদের নিরাপত্তার জন্য ডিবিতে আনার জন্য। তখন বলি আমি তাদের কিভাবে নেবো?
তিনি আরো বলেন, তখন তারা বলে এতকিছু বুঝার দরকার নাই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবো আপনি নিয়ে রাখেন। আমাকে কমিশনারসহ কোর কমিটির সবাই এই কথা বলেছে। এরপর আমি ডিবির রমনা বিভাগের ডিসি হুমায়ুনকে সমন্বয়ক তিনজনকে নিয়ে আসতে বলি। হুমায়ুন তাদের নিতে আসে। তাদের মোবাইল আগেই ডিজিএফআই নিয়ে গেছিলো। রাত ২টা-তিনটার দিকে আমাকে ডিজিএফআইয়ের দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন দিয়ে বলে সারজিসসহ আরও দুইজনকে ডিবি গেইটে আনা হয়েছে। আপনার কোনো এক কর্মকর্তাকে বলেন রিসিভ করতে। পরে আমি ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেনশাহ মাহমুদকে ফোন দিয়ে বলি রিসিভ করতে। পরে তাদের সাইবারের একজন এডিসি রিসিভ করে। এই হলো পাঁচজন। পরের দিন ডিজিএফআই প্রধান আমাকে ফোন দিয়ে বলেন একটি মেয়ে (নুসরাত তাবাসসুম) খুব উৎপাত করছে তাকেও তুলে আনতে হবে। আমি মিরপুরের ডিসি মানস কুমার পোদ্দারকে বলি তাকে আনতে। এই ছয়জন হলো। এরপর আমাকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী পুলিশ হাসপাতালে যাওয়ার পরে আমাকে কাজের আপডেট জানতে চান এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম। আমি বিস্তারিত তাকে পাঠাই। আগে তাদের বিভিন্ন সংস্থা মারধর করেছে। কিন্তু আমি তাদের (সমন্বয়ক) স্বজনদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছি। আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে আমি ভাতও খেয়েছি। ওই মেয়েটার মাকে এনে তার সঙ্গে রাখা হয়েছে। এরআগে আরেকটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিলো আইন সচিবের সঙ্গে আমার কথার। আমি আইন সচিবকে বলি আমি তাদের ধরি নাই। কিন্তু আমাকে কালার করা হচ্ছে। তখন কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়ায় আসছিলো তাদের ডিবিতে আটকে রাখা হয়েছে। আমি তো কোনো কুলই পাচ্ছি না। সাধারণ মানুষ জানতেছে তাদের আমি আটকে রেখেছি। আমি হারুন তাদের সঙ্গে কোনো খারাপ কথা বলিনি। ভিপি নুরের সঙ্গেও দুজন সমন্বয়কের কথা বলিয়ে দিয়েছি। তারা যাওয়ার পরে কিন্তু এখন পর্যন্ত বলে নাই হারুন তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার ক্ষতিটা হলো মানুষ জানলো হারুন তাদের ধরে নিয়েছে।
এতো সংস্থা থাকতে ডিবিকে দিয়ে কোনো এই কাজটি করাতে গেলো। আপনার তো অতিউৎসাহী মনোভাব ছিলো। এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, এখনও তো সব গ্রেফতার ডিবি করছে। সারাদেশে ধরা হচ্ছে তাদের তো ডিবিতে নেওয়া হচ্ছে। আমি ডিবিকে মানুষের আস্থার স্থানে নিয়ে এসেছি। বিএনপি যত নেতাকে গ্রেফতার করে ডিবিতে এনেছি। কেউ বলতে পারবে না কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি কখনো খারাপ ব্যবহার করিনি। মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যার ঘটনায় ৩৩ জন দলীয় নেতার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছি। এতে দলের নেতারা ক্ষুব্ধ হয়েছে। সর্বশেষ এমপি আনার হত্যার ঘটনায় নেপাল, ভারত এমন কি পাহাড় থেকে আসামি ধরে এনেছি। জেলার সাধারণ সম্পাদককে ধরেছি। তার মানে কোনো ঘটনা ঘটলে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে জড়াইনি। আমার এমন কাজে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনেকে ক্ষিপ্ত হয়েছে।
শেখ হাসিনা সবাইকে বিপদে ফেলে চলে গেছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। আমি ছোট মানুষ। আমি ডিএমপির প্রধানও না, পুলিশের প্রধান না। আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমাকে মোয়া বানানো হচ্ছে। আমি কেনো আলোচিত-এর একটাই কারণ যেখানে অপরাধ হয়েছে সেখানে আমি মানুষকে সেবা দিয়েছি। মানুষ যখন যে সমস্যায় পড়েছে তারা থানায় না গিয়ে ডিবিতে আসতো। ডিবিতে আমার চাকরি জীবনে মানুষের উপকার করেছি। কারো ক্ষতি করি নাই।
সরকারের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে আপনি অনুতপ্ত কি না জানতে চাইলে ডিবির সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, আমি লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করিনি। আমি সরকারি চাকরি করি। আমার সঙ্গে কোনো দিন শেখ হাসিনার দেখা হয় নাই। ১৫ বছরের ক্ষমতাকালীন সময়ে কোনো দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। আমার সঙ্গে কথা হয় নাই। আমাকে বলা হচ্ছে হুকুমদাতা। আমি হুকুমদাতা কিভাবে হলাম। আমি তো ডিএমপি কমিশনারের অধীনে কাজ করেছি। আমি যা করেছি ন্যায়বোধ থেকে করেছি। অন্যায় কিরিনি। ন্যায়বোধ দিয়ে কাজ করায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েছি। কিন্তু মানুষ আমার কাজের প্রশংসা করেছে। আমাকে ভুল বুঝার অবকাশ নাই।