স্টাফ রিপোর্টার ।।
দুর্নীতির মামলায় জেমকন গ্রুপের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী আনিস আহমেদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁর ২০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে এবং প্রায় ১০০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. সাব্বির ফয়েজ এ আদেশ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. রিয়াজ হোসেন।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, কাজী আনিস আহমেদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ৮০ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন ও ভোগ করেছেন। তাঁর নামে, যৌথ নামে এবং প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ২০টি হিসাব পরিচালনার প্রমাণ মিলেছে—যেখানে ৪০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা জমা এবং ৩৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এসব লেনদেনকে দুদক ‘অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক’ বলে মনে করছে।
জব্দ হওয়া সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকা ও পঞ্চগড়ে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার জমি ও ফ্ল্যাট এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা ৮৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। দুদক আশঙ্কা করছে, অভিযুক্ত দেশত্যাগ বা সম্পদ হস্তান্তরের চেষ্টা করতে পারেন, যা তদন্তে বাধা সৃষ্টি করবে। তাই তাঁর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ জব্দের আবেদন মঞ্জুর করা হয়। আদালত জব্দ করা স্থাবর সম্পত্তি তদারকির জন্য একজন রিসিভার নিয়োগের নির্দেশও দিয়েছেন।

কাজী আনিস আহমেদ। নেত্রনিউজের সৌজন্যে
বিতর্কিত বিদেশি লবিংয়ের অভিযোগ
সম্প্রতি অনুসন্ধানমূলক মাধ্যম Netra News–এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে কাজী আনিস আহমেদকে ঘিরে নতুন এক আন্তর্জাতিক বিতর্কের সূত্রপাত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে একটি গোপন রাজনৈতিক লবিং কার্যক্রমে অর্থায়ন করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা এবং তাঁর বিরোধীদের হেয় করা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাজী আনিস আহমেদ সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি Green Perspective FZE–এর মাধ্যমে মার্কিন লবিস্ট সেথ ওল্ডমিকসন পরিচালিত সংগঠন Liberty South Asia-এ অর্থ পাঠান। এই লবিং কার্যক্রমে ব্যয় হয় প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। ওল্ডমিকসনের নেতৃত্বে এ অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর, প্রতিরক্ষা দফতর এবং কংগ্রেসের বিভিন্ন সদস্যকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালায়।
এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চারটি কংগ্রেসীয় প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে কিছুতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগও ওঠে। এছাড়া বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ভাবমূর্তি নষ্ট এবং শেখ হাসিনার সরকারের প্রশংসা বাড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল বলে দাবি করেছে Netra News।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাজী আনিসের মালিকানাধীন Green Perspective নামের প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে দুবাই সরকারের রেজিস্ট্রিতে নিবন্ধিত এবং সেই উৎস থেকেই লবিংয়ের তহবিল সরবরাহ করা হয়। এ প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই দেশের আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি বহন করেছিল বলে উল্লেখ করা হয়।

জেমকন গ্রুপ লোগো
বিতর্কিত পটভূমি ও প্রভাব
৫৪ বছর বয়সী কাজী আনিস আহমেদ একজন উচ্চশিক্ষিত কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করা এই ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কলাম লেখেন The New York Times ও The Guardian-এ। তিনি বাংলাদেশের PEN International-এর সভাপতি হিসেবেও পরিচিত, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন।
তাঁর নেতৃত্বে কাজী পরিবারের গণমাধ্যম সাম্রাজ্য—প্রিন্ট দৈনিক Dhaka Tribune, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম Bangla Tribune, সাহিত্যপত্রিকা ও দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান—নতুনভাবে গড়ে ওঠে। তবে লাভজনকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে; প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকেরা অনেক সময় বেতন বিলম্বে পান, আর কিছু লেখক রয়্যালটি না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
কাজী আনিস আহমেদ ও তাঁর পরিবারের রাজনীতিসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক দীর্ঘদিনের আলোচনার বিষয়। সাম্প্রতিক দুর্নীতি মামলা ও বিদেশি লবিং কেলেঙ্কারি তাঁর ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে নতুন বিতর্কে ফেলেছে।