বিদিশা সিদ্দিক ।।
কঙ্কালে অলংকার দিও।
বেঁচে থেকেও তিনি পরকাল নিয়ে লিখে গিয়েছিলেন কি সুন্দর তার মৃত্যু চিন্তা তখনো।
আব্বার লেখা এই কবিতাটা আমি প্রায় পড়ি, আর এখন কাঁদি, কি শব্দ কি অনুভূতি, কি ভাষা। বহুমাত্রিক বহু কৌণিক গুণী একজন লেখক।
উনি বেঁচে থাকতে আমি উনাকে প্রায় বলতাম আমার সামনে আপনি থাকতে আপনার কবিতা পড়ার প্রয়োজন নেই, আপনার লেখা কঠিন, এত কঠিন লেখা আমি বুঝিনা। আমার বাংলা খুব খারাপ।
আব্বাও বলতেন আমায় কষ্ট করে পড়তে হবে না। শুধু বাংলা নিউজ পেপার গুলো পড়ো তুমি। আব্বা জানতেন, অনুভব করতেন আমার বাংলা ভাষার প্রতি টান, ভালোবাসা সবই অটুট। কিন্তু যেহেতু আমি ছোটবেলায় লন্ডনে চলে গেছি স্কুলে পড়তে সেজন্য বাংলায় বেশ পিছিয়ে গিয়েছিলাম, পড়তে আমার অনেক কষ্ট হতো তারপরেও আমি কখনো বাদ দেইনি পড়া। নিজেকে নিজে পড়িয়েছি, শিখিয়েছি।
আজ আব্বার জন্মদিন, বেঁচে থাকলে ৯১ বছর হতো উনার।
গত বছর আব্বার জন্মদিন করতে খুলনায় আমরা সবাই ছিলাম। ছেলে মেয়েরা লন্ডন থেকে এসেছিল ।কেউ বুঝতে পারেনি গত বছর জন্মদিনে হবে আমাদের সাথে উনার শেষ জন্মদিন । সবাই নানার সাথে কেক কাটলো। উনি ছোট মানুষের মতো কেকের উপরের ক্রিম গুলা আঙ্গুল দিয়ে চেটে চেটে খাচ্ছিলেন ,মায়া নানার কান্ড দেখে হাসাহাসি করছিলো। আব্বা খুব মিষ্টি জিনিস খেতে পছন্দ করতেন সে রোগটা অবশ্য আমিও পেয়েছি, আজ ও প্রতিদিন মিষ্টি খাওয়া চাই আমার ও।
খুলনা বাড়ির পাশেই যে মিষ্টি দোকানটা আছে সে সবসময় আব্বার জন্য ফ্রেশ গরম মিষ্টি পাঠাতো।
১৯ অগাস্টের পরেও ২৭শে ডিসেম্বর পর্যন্ত আব্বা বেঁচে ছিলেন উনিও হয়তো টের পেয়েছিলেন পৃথিবীতে উনি হয়তো আর বেশি দিন নেই। ইজাবেলার হাত ধরে বসেছিলেন অনেকক্ষণ তিনি বারবার ইজাবেলার কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে চাইতেন, নানা নাতির কথা বলার টপিক ছিল আস্তে আস্তে পৃথিবীতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে যেভাবে , প্রকৃতির উপরে মানুষের কত প্রেশার,বন উজার হয়ে যাচ্ছে, মানুষ গাছপালা কেটে ফেলছে।ইজাবেলাকে অনেক দোয়া করলেন ওর ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে কাজ করা, বাংলাদেশ নিয়ে এত গবেষণা করার জন্য। আমি পায়ের নখগুলো কেটে দিলাম যত্ন করে তারপর বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকলাম কয় মিনিট। আমার দেখাদেখি মায়া ও তাই করল তারপর মায়া চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিল যত্ন করে । এরিক কয়েকটা গান শোনালো আব্বাকে। তারপর আড়ং থেকে কেনা সাদা ফতুয়া টা পড়িয়ে দিল নানাকে এরিক। উনি খুশি হয়েছিলেন বলেছিলেন আমার তো বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না এখন আর। অথচ একসময় ধোপার বাড়ি থেকে আব্বার গরম ইস্ত্রি করা খাদির পাঞ্জাবি গুলো ভাঁজ করে দিয়ে যেত, মা যত্নে উঠিয়ে রাখত বাড়ির আলমারিতে। সেই আমলেই সে মোস্ট ফ্যাশনেবল কবি হিসেবে জনপ্রিয়।
আমার সাথে পলিটিক্যাল ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে চাইলেন। দেশ জাতি ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। আমাকে মানা করে বললেন আমি যেন এই সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথা না বলি। আমি কথা দিয়েছি, কথা রেখেছি ও। আব্বার সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে।
স্কুলে পড়া না পারলে যখন আমাকে পানিশমেন্ট দিতেন আব্বা কষ্ট পেতেন, পরে শিক্ষকদের কাছে যেয়ে বলে আসতেন আমাকে যেন জোর করে পড়াশোনা না শেখানো হয়। আমি নিজের ক্লাসরুমে ক্লাস বাদ দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে আব্বার ক্লাসে পড়ানো রবীন্দ্রনাথ মন দিয়ে শুনতাম সেই বয়সে। সারাদিন রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান আওড়াতাম।
কোন কারনে আমার মা আমাকে মারলে আমার বাবা পাহাড়ের মত সামনে এসে দাড়াতেন আর আমি তার লম্বা চড়া শরীরের পিছে লুকিয়ে পড়তাম।
আমি খুব ছোটবেলা থেকেই ইন্ডিপেন্ডেন্টলি একা বড় হয়েছি। পৃথিবীর যে প্রান্তে থেকেছি সবসময় মনে হয়েছে আব্বা আছে।
২০০৫ এ যখন রাজনৈতিক কারণে জেলে গিয়েছি আমার আব্বা তখন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন। যেদিন আমি মুক্তি পেলাম জেল গেটে আব্বা আমাকে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলেন। একটা বাবা তখন শিশু হয়ে গেলেন।
এরপর থেকে আব্বা আমাকে চোখে চোখে রাখতেন। কখনো কোন কিছু চাপিয়ে দিতেন না।
আমার লেখা দুটি বই নিয়ে অনেক গর্ব করতেন তিনি।
বলেছিলেন এর পরের বইটা নাম যেন “অদম্য” নামকরণ করি।
হয়তো শুরু করব শীঘ্রই।
হ্যাপি বার্থডে বাপি।
_______________________________________
_______________________________________
কঙ্কালে অলংকার দিও
কবি আবু বকর সিদ্দিক
দেবার আগে ভাবতে দিয়ো,
কালো খামে শুইয়ে দেবে
তার আগে চোখ মেলতে দিয়ো।
জিভের ডগায় ধরতে দিয়ো,
সবার কাছে ভালো ভালো
ছোট্ট করে বলতে দিয়ো।
কালো খামে মুড়ে দিয়ো,
দেবার আগে মিনিট পাঁচেক
ভালোমন্দ ভাবতে দিয়ো।
কংকালে অলংকার দিয়ো,
ময়ূরপাখার কলম কেটে
কুশলকথা লিখে দিয়ো,
কিছু কথা না বলা থাক
একা একা থাকতে দিয়ো।
শাপেতাপে গলতে দিয়ো,
নামিয়ে দেবার আগে শুধু
মিনিট পাঁচেক দেখতে দিয়ো।
কংকালে অলংকার দিয়ো।
_______________________________________