সোমবার, ডিসেম্বর ৮, ২০২৫

রাজউকের ৩০ হাজার নথি গায়েব: দায়ীদের শাস্তি নয়, চলছে ‘উদ্ধার’ নাটক

by ঢাকাবার্তা
রাজউক ভবন

স্টাফ রিপোর্টার ।।

রাজউকের বহুল আলোচিত ৩০ হাজার নথি গায়েব হওয়ার ঘটনায় এখনো দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হলেও তা মানেনি রাজউক। এমনকি হাইকোর্ট থেকে সুয়োমটো রুল জারি করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও সেটিও উপেক্ষা করেছে সংস্থাটি।

রুল জারির পর রাজউকের পক্ষ থেকে আদালতে জানানো হয়—হারিয়ে যাওয়া ফাইলগুলো ‘পাওয়া গেছে’। কিন্তু কীভাবে রাজউকের সফটওয়ার থেকে এসব ডাটা গায়েব হলো এবং পরে কীভাবে উদ্ধার হলো—সে বিষয়ে রাজউকের কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এমনকি হাইকোর্টে জমা দেওয়া জবাবেও এ সংক্রান্ত কোনো ব্যাখ্যা উঠে আসেনি।

উল্লেখযোগ্য যে, এসব নথি গায়েব হয় এমন এক সময় যখন রাজউকের ‘ড্যাপ’ বাস্তবায়ন নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছিল। ২০২২ সালের ২৩ আগস্ট সরকার ঢাকা মহানগরের জন্য রাজউকের প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুমোদন দেয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, অধিকাংশ এলাকায় আগের তুলনায় কম উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে বলা হয়। জমির মালিক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরে রাজউক সিদ্ধান্ত নেয়—২৩ আগস্টের আগে যারা ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র চেয়েছিলেন, তারা আগের নিয়মে ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। এই সিদ্ধান্তের পর ৪ ডিসেম্বর রাজউক একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। আর ঠিক এর একদিন পর, ৬ ডিসেম্বর রাজউকের ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত ওয়েবসাইট অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিছুদিন পর জানানো হয়, ৩০ হাজার ফাইল ‘গায়েব’ হয়ে গেছে।

শুরু থেকেই সন্দেহের কেন্দ্রে ছিল রাজউকের নিজস্ব কর্মকর্তারা এবং তাদের তথ্যপ্রযুক্তি অংশীদার প্রতিষ্ঠান টেকনো হেভেন। অভিযোগ ওঠে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ফাইল গায়েবের ঘটনা ঘটানো হয়েছে যাতে ‘বিশেষ সুবিধার’ বিনিময়ে প্ল্যান পাস করিয়ে দেওয়া যায়। পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায়, ফাইল পাওয়ার নামে নগদ অর্থ লেনদেন হয়েছে এবং যাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া হয়েছে, তাদের ফাইল উদ্ধার দেখিয়ে প্ল্যান পাস করা হয়েছে।

এই দুর্নীতির দায়ে শুধুমাত্র টেকনো হেভেন নয়, তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ রাজউকের অনেক ঊর্ধ্বতন ও অধঃস্তন কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন। গণমাধ্যম বিশেষ করে সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজ-এর ২০২৩ সালের ১ মে সংখ্যায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর ‘হারিয়ে যাওয়া’ ফাইল উদ্ধার দেখানোর নাটক শুরু হয়।

সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড (বিডিসিসিএল) জানিয়েছে, তাদের সার্ভারে সংরক্ষিত রাজউকের কোনো ফাইল বা সফটওয়্যার কখনো গায়েব হয়নি, এমনকি সাময়িক সময়ের জন্যও নয়। তাদের মতে, বিশ্বের সর্বাধুনিক মানের এই ফোর-টায়ার ডাটা সেন্টারে চারস্তরের ব্যাকআপ ব্যবস্থা থাকায় ডাটা হারানোর সুযোগ নেই।

তবুও রাজউক থেকে জানানো হয়, ৩০ হাজার ফাইল গায়েব হয়েছে। কিন্তু ডাটা সেন্টারকে কখনো লিখিতভাবে কিছু জিজ্ঞেসও করেনি রাজউক। এমনকি ক্ষতিপূরণ দাবির ন্যূনতম চিঠিও পাঠানো হয়নি। শুধু রাজউকের পক্ষ থেকেই ‘ফাইল গায়েব’—এই কথা প্রচার করা হয়।

বিডিসিসিএলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, “রাজউক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই দাবি একেবারেই মিথ্যা। নিজেদের স্বার্থে বাজারে এসব গুজব ছড়ানো হয়েছে।”

২০২৩ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট রাজউকের প্রতি সুয়োমটো রুল জারি করে চার সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু রাজউক চার মাস পরে, ৩০ এপ্রিল আদালতে একটি জবাব দাখিল করে, যেখানে বলা হয়—ফাইলগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ‘কীভাবে গায়েব হলো, কীভাবে পাওয়া গেল’—সে বিষয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো তথ্য ছিল না।

তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়েও কোনো অগ্রগতি নেই। আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে এবং তদন্তের নামে গড়িমসি করে রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হাইকোর্টকেও বিভ্রান্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মাধ্যমে আদালতকে ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছিল বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে, মন্ত্রণালয় থেকেও একইদিন (২ জানুয়ারি) রাজউককে চিঠি দিয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট চাওয়া হলেও সেই নির্দেশও উপেক্ষা করেছে তারা।

রাজউকের ৩০ হাজার নথি গায়েবের ঘটনাটি কেবল তথ্যপ্রযুক্তির কোনো ত্রুটি ছিল না, বরং এটি ছিল সুপরিকল্পিত দুর্নীতির একটি দৃষ্টান্ত। হাইকোর্টের আদেশ ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে রাজউক যে আত্মঘাতী পথ বেছে নিয়েছে, তা প্রতিষ্ঠানটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বড় প্রশ্ন তুলে ধরেছে।

সৌজন্যে, শীর্ষনিউজ

 

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net