স্টাফ রিপোর্টার ।।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর সেবা পেতে গিয়ে সাধারণ নাগরিকদের দুর্নীতি, ঘুস ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বরাদ্দপত্র, নকশা অনুমোদন, ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র—সব সেবাতেই রয়েছে অনিয়ম ও হয়রানি। সেবাপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর পরিবর্তনের আশায় থাকলেও বাস্তবে রাজউকের সেবায় তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।
রাজউকের সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয় নকশা অনুমোদন ও ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র পেতে। একাধিক জমির মালিক ও ডেভেলপার জানান, নকশা অনুমোদনে ঘুস এখন বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বাড়ি নির্মাণের বাজেটেই ঘুসের জন্য আলাদা টাকা রাখেন। অভিযোগ অনুযায়ী, ৫ লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুস দিতে হয় নকশা অনুমোদনের জন্য।
নকশা-সংক্রান্ত দুর্নীতি ঠেকাতে ২০২২ সালে চালু হয় অনলাইন ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমিটিং সিস্টেম (ইসিএসপি)। কিন্তু সেবাপ্রত্যাশীদের অভিজ্ঞতা বলছে, এই ওয়েবসাইট কেবল নামমাত্র চালু। সব কাজ এখনো টেবিলে টেবিলে হয়। অনলাইনে ফাইল জমা দেওয়ার পর সাধারণত তা ‘ভুল’ বলে রিজেক্ট করা হয়। কারণ না জানিয়ে জমির মালিককে অফিসে এসে দেখা করতে বলা হয়, আর সেখানেই ঘুসের লেনদেন ঘটে। রাজউক সূত্র জানিয়েছে, গত দুই মাস ধরে অনলাইন সেবা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, অনিয়ম বন্ধে রাজউকের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউকের সেবা এত জটিল যে মানুষ প্রতিষ্ঠানটির নাম শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য কাগজ জমা দিতে হয়, যেটা ইচ্ছা করলেই সহজ করা যেত।
রাজউকের ভবন তদারকির ক্ষেত্রেও রয়েছে বড় ধরনের গাফিলতি। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবনের নির্মাণে নকশা লঙ্ঘন রোধ করা সম্ভব হতো যদি রাজউক ঘুষ না খেত। নকশা অনুমোদন, নির্মাণ পরিদর্শন ও বসবাসের অনুমতিপত্র—সব পর্যায়েই ঘুষ খাওয়া হয়। দুর্ঘটনা ঘটলে দোষ চাপানো হয় নকশার ব্যত্যয়ের ওপর।
ভ্যারিয়েডস বিল্ডারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, রাজউক নিয়ম ভেঙে কিছু করে না বলেই দাবি করে, কিন্তু মালিকদের সঙ্গে অলিখিত চুক্তি করে নীরব থাকে। ভবন নির্মাণে নকশা মানা না হলেও পদক্ষেপ নেয় না, ঘুষ থাকলে সব চলে।
বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার জন্য ২০২৩ সালে ড্যাপ (Detailed Area Plan) গেজেট প্রকাশ করা হলেও তা নতুন ভোগান্তি ডেকে এনেছে। নির্মাণ কাজ বন্ধ, বিপুল ঘুষে ব্যাকডেটে অনুমোদন, গেজেট সংশোধনের ধারা—সবকিছু মিলিয়ে ড্যাপ এখন জটিলতার নাম।
রাজউকের হেড অফিসে ফাস্টট্র্যাক সেবা চালু হলেও বাস্তবে তা কেবল হেল্প ডেস্ক হিসেবে কাজ করে। কোনো তথ্যভাণ্ডার না থাকায় সেবাপ্রত্যাশীরা প্রকৃত সাহায্য পান না।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাজউক নানা উদ্যোগ নিয়েও কাজের কাজ কিছু করতে পারেনি। তিনি পরামর্শ দেন, কর্মকর্তারা একবার টেবিলের এ পাশে এসে ভোগান্তির স্বাদ নিক, তাহলে বুঝবেন অবস্থা কতটা ভয়াবহ।
তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ রাজউকের প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের সদস্য ড. মো. আলম মোস্তফা। তিনি বলেন, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ৪৮ জন কর্মকর্তা বরখাস্ত হয়েছেন, ১৮ জন বদলি হয়েছেন। দুর্নীতি কমাতে এটা বড় পদক্ষেপ। অনলাইন সেবা ফের চালুর চেষ্টা চলছে। অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঠামোগত পরিবর্তন না হলে রাজউকের দুর্নীতি ও জনভোগান্তি কমবে না। নাগরিক সেবায় বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারই এখন সময়ের দাবি।