স্টাফ রিপোর্টার ।।
১১৭ বছর ধরে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত রয়েছে ঢাকার নবাব পরিবারের বিখ্যাত দরিয়া-ই-নূর হীরাসহ ১০৯টি রত্ন। সরকারি নথি বলছে, ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহর নেওয়া এক ঋণের বিপরীতে এসব রত্ন বন্ধকি সম্পদ হিসেবে জমা রাখা হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে ঋণের মেয়াদ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত ব্রিটিশ, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ—কোনো সরকারই এ সম্পদ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।
নবাব সলিমুল্লাহ ছিলেন শিক্ষাবিস্তার ও মুসলিম রাজনীতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে বিপুল অর্থ ব্যয় করায় তিনি আর্থিক সংকটে পড়েন। শেষমেশ জমি ও সম্পত্তি বন্ধক রেখে এক মাড়োয়ারি ও এক হিন্দু মহাজনের কাছ থেকে ১৪ লাখ রুপি ঋণ নেন। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আদালতে মামলায় হেরে যান তিনি। তখন ব্রিটিশ সরকার ঋণ পরিশোধ করে সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে নেয়।
১৯০৮ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের কাছ থেকেও তিনি ১৪ লাখ রুপি ঋণ নেন, যার বিপরীতে দরিয়া-ই-নূরসহ ১০৯ রত্ন বন্ধক রাখা হয়। দেশভাগের আগে রত্নগুলো ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায়, পরে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে সংরক্ষিত।
ভূমি সংস্কার বোর্ড বলছে, ঋণ সুদে-আসলে শোধ হয়েছে এমন প্রমাণ নেই। তবে ১৯৩৬ ও ১৯৩৭ সালের নবাব এস্টেটের চিঠি অনুযায়ী, ঋণের বড় অংশ পরিশোধ হয়েছিল, শেষদিকে প্রায় ৩ লাখ ৮৪ হাজার রুপি বাকি ছিল। ২০০৩ সালে নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে ঋণের অবস্থা জানতে চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হলেও চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
সরকারের মতে, ঋণ শোধ না হওয়ায় সম্পদের মালিক সরকার। কিন্তু নবাব পরিবারের সদস্য খাজা নাইম মুরাদ (চিত্রনায়ক নাইম) দাবি করেন, রত্নগুলোর মালিকানা তাঁদের, আর ঋণ থেকে থাকলে তাঁরা তা পরিশোধ করতে প্রস্তুত। তাঁদের দাবি, একটি স্বচ্ছ তদন্ত কমিটি গঠন করে ঋণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করতে হবে এবং রত্ন ফেরত দিতে হবে।
বর্তমানে কোর্ট অব ওয়ার্ডস নবাব পরিবারের প্রায় ৬০০ একর জমি দেখভাল করছে, যেখান থেকে গড়ে ১.৫ কোটি টাকা আয় হয়, যার মধ্যে মাত্র ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় উত্তরসূরিদের।
দরিয়া-ই-নূরসহ রত্ন যাচাইয়ের জন্য গত ২৬ মে ভূমি মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সভা হয়নি। নবাব পরিবারের দাবি, কমিটিতে তাঁদের প্রতিনিধি থাকতে হবে।
ইতিহাস গবেষক হাশেম সূফী বলেন, আধুনিক ঢাকার গোড়াপত্তনকারী নবাব পরিবারের সম্পত্তির জটিলতা দ্রুত নিরসন দরকার। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের সাবেক কিপার অধ্যাপক মো. আলমগীর বলেন, রত্নগুলো নবাব এস্টেটেরই সম্পদ। ঋণ শোধ হয়নি যদি, তবে আইনগত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে এবং নবাব পরিবারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তা করা উচিত।
এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বন্ধক রাখা রত্নগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। স্বচ্ছ তদন্ত, সঠিক তথ্য ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ বিতর্কের অবসান এখন সময়ের দাবি।