রবিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৫

তুরাগের বুকে বেআইনি বসতি: বৈধতা দিতে নীতিমালার পথে রাজউক

হাউজিং কোম্পানিগুলো অনুমোদন ছাড়াই বসতি গড়ে তোলে, পরে সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগও চলে যায়।

by ঢাকাবার্তা
এভাবেই বিলীন হচ্ছে ঢাকার নদ-নদী

স্টাফ রিপোর্টার ।। 

নগরায়ণের দুর্বার চাপে রাজধানী ঢাকার সীমা যেমন বিস্তৃত হচ্ছে, তেমনি পাল্টে যাচ্ছে এর ভৌগোলিক চরিত্রও। মোহাম্মদপুরের বসিলা অঞ্চল, যেখানে একসময় ছিল নদী, খাল ও ধানক্ষেত, এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ ভবন আর হাউজিং প্রকল্প। বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই জায়গাগুলো একসময় বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর প্লাবনভূমি ছিল। অথচ সেখানে এখন চলছে ঘনবসতি। নদী-খাল দখল করে গড়ে ওঠা এই অবৈধ স্থাপনাগুলোকে এখন আইনি কাঠামোর আওতায় আনার চিন্তাভাবনা করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তবে রাজউক স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—নদী, খাল, পুকুর কিংবা সরকারি জমি দখলকারীদের জন্য কোনো ছাড় থাকবে না।

বসিলার উত্তরপাড়ার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব জেয়ারত আলীর মতো স্থানীয়রা একসময় নৌকায় করে সাতমসজিদ পর্যন্ত যেতেন। তিনি বলেন, ‘এখানে ছিল বান্দা খাল আর মাছপুরা খাল। চোখের সামনে সব ভরাট হয়ে গেছে।’ স্থানীয়দের মতে, একসময় যে খালগুলো সাতমসজিদ পর্যন্ত যেত, সেগুলোর অস্তিত্ব এখন বেড়িবাঁধ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

ঐতিহাসিক দলিল ও আলোকচিত্রও এ দাবিকে সমর্থন করে। নগর গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম জানান, ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার রজার গুইনের ষাটের দশকের ছবিতে দেখা যায় সাতমসজিদের ঠিক পরেই ছিল নদী। এমনকি আশির দশকেও ল্যারি স্পেকের তোলা ছবিতে একই প্রমাণ পাওয়া যায়। পাকিস্তান আমলেও এখানে ধান চাষ হতো। মোহাম্মদপুর তখন ছিল পরিকল্পিত আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও নগর গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ’৯২-’৯৩ সাল পর্যন্ত সাতমসজিদের পর নদীর জায়গায় ধান চাষ দেখেছি। কিন্তু শহর রক্ষা বাঁধ হওয়ার পর থেকেই নদীর জায়গা দখল হতে শুরু করে। হাউজিং কোম্পানিগুলো অনুমোদন ছাড়াই বসতি গড়ে তোলে, পরে সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সংযোগও চলে যায়। রাজউক কোনো প্ল্যান না দিলেও সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর অনুমোদনে ঘরবাড়ি উঠে যায়।’

তিনি আরও বলেন, এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নাগরিক সেবা দেওয়া কঠিন। ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য নিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা—সবই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। খালগুলো পরিষ্কার করলেও দ্রুত আবার নোংরা হয়ে যায়, যা অতিরিক্ত জনচাপের প্রতিফলন।

২০১০ সালের বিস্তারিত এরিয়া পরিকল্পনায় (ড্যাপ) বসিলাকে প্লাবনভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ড্যাপে সেখানে কিছু এলাকা নন-কনফার্মিটি ও ওভার-লে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়—শর্তসাপেক্ষে যেখানে কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে, তবে পরিবেশ ও খালের চরিত্র নষ্ট না করার শর্তে।

স্থপতি ও ড্যাপ রিভিউ কমিটির সদস্য ইকবাল হাবিব বলেন, ’৮৮ সালের বন্যার পর এরশাদ সরকার যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছিল, তা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বদলে গেছে। বুড়িগঙ্গা সরতে সরতে এখন তুরাগই টিকে আছে। রাজউক যদি বেড়িবাঁধের বাইরে স্থাপনা নিষিদ্ধ করত, তাহলে পরিস্থিতি এমন হতো না।’

বর্তমানে রাজউক একটি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে, যেখানে বলা হয়েছে—সব অবৈধ স্থাপনাকে এক ক্যাটাগরিতে দেখা হবে না। যার যতটুকু ব্যত্যয়, তার ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে—জরিমানা, বৈধতা অথবা ভাঙার সিদ্ধান্ত।

পরিবেশবাদী সংগঠন স্রোত-এর নির্বাহী পরিচালক হামীম কেফায়েত বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, শহর রক্ষার নামে প্রকৃতিকে হত্যা করে কোনো উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। মোহাম্মদপুর ও বসিলার মতো এলাকাগুলোতে যেভাবে নদী ও খাল দখল করে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে, তা শুধু পরিবেশ নয়, ঢাকার অস্তিত্বের জন্যও হুমকি। রাজউক যদি আজ বাধ্য হয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করে, তবে বুঝতে হবে—আমরা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় কতটা ব্যর্থ হয়েছি। পরিবেশ রক্ষার নামে বৈধতা দেওয়ার এই প্রক্রিয়া যেন আবারও পরিবেশবিধ্বংসী কার্যক্রমের লাইসেন্স না হয়ে দাঁড়ায়, সে বিষয়ে আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।”

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম জানান, ড্যাপে বসিলার বড় অংশ প্লাবনভূমি উল্লেখ থাকলেও সেখানে সরকারি উদ্যোগেই বিদ্যুৎ-গ্যাস-সড়ক পৌঁছে গেছে। ফলে বসতি গড়ে উঠেছে। এখন নীতিমালার মাধ্যমে যাচাই করে দেখা হবে কার কতটা ব্যত্যয় হয়েছে। আইন মানলে জরিমানা দিয়ে বৈধতা মিলবে, আর আইন ভাঙলে ভবন ভাঙা হবে।

রাজউকের সূত্রে জানা গেছে, খসড়া নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে নদী, খাল ও সরকারি জমি দখলকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না—সরাসরি উচ্ছেদ করা হবে। অতীতের ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে ভবিষ্যতের শহর যেন আরও অগোছালো না হয়ে পড়ে, সেই লক্ষ্যে রাজউকের এই উদ্যোগকে অনেকে দেখছেন ঢাকার টিকে থাকার লড়াইয়ের অংশ হিসেবে।

You may also like

প্রকাশক : মানজুর এলাহী

সম্পাদক : হামীম কেফায়েত

ব‌ইচিত্র পাবলিশার্স
প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
যোগাযোগ : +8801712813999
ইমেইল : news@dhakabarta.net